ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। কিন্তু তিনি কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নবেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, তমুদ্দুন মজলিসের আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোন সাড়া দেননি। ভাষা সমস্যার প্রস্তাবিত সমাধানের জন্য পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার বিষয়ে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। তবে এটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। এখানে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়। ভাষাবিদ গোলাম সারোয়ার চৌধুরীর লেখায় বলা হয়েছে, ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এ জন্য, সব জাতীয় বা মাতৃভাষার উৎপত্তিই আসলে আঞ্চলিক ভাষা থেকে। রাজধানীকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ভাষাই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিকভাবে পরিপুষ্ট হয়ে প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্জন করে জাতীয়, মাতৃ বা রাষ্ট্রভাষায় পরিগণিত হয়। মোটামুটি সব বিশ্ব ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে এ তত্ত্ব প্রায় নির্ভুল মনে হবে। লাতিন রোমকেন্দ্রিক, ইংরেজী লন্ডনকেন্দ্রিক এবং বাংলা কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষা হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকরণ, ব্যবহার ও উচ্চারণের এত বিপুল তফাত দেখে বছর দশেক আগে এ প্রশ্ন আমাকে বিচলিত করেছিল যে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা আসলেই বাংলা ভাষার জাত কি-না। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখসহ চট্টগ্রামবাসীর লেখা পড়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বস্তুত বাংলা ভাষারই একটি অপভ্রংশ রূপ এবং আরাকানী রাজত্বের প্রভাবে এটি বিপুলভাবে সংকরায়িত হয়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রায় নিঃসম্পর্কিত একটি আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। তাই অন্য যে কোন জেলার লোকের মতো চট্টগ্রামের লোকের মাতৃভাষা বা জাতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা। চট্টগ্রামের কেউ শুধু আঞ্চলিক ভাষা জানলেও তার মাতৃভাষা ধর্তব্য হবে বাংলা বলে। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন ঠিক বিকেল ৩টার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়ে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তায় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর পুলিশবাহিনী নিরীহ ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই দিন চিত্রগ্রাহক আমানুল হকের ক্যামেরায় ধরা পড়ল শহীদ রফিকউদ্দিনের গুলি খাওয়া মাথার মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে থাকার ছবি। একুশের প্রথম শহীদ। একই দিনে মারা যান আরও চারজন- বরকত, জব্বার, সালাম আর বালক অহিউল। এর পরদিন মারা যান শফিউর। রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিজয় লাভ করে বীর বাঙালী।
×