ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘালয়ে বিএনপির সেই নিরুদ্দেশ নেতার বিলাসী জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১০ জানুয়ারি ২০১৬

মেঘালয়ে বিএনপির সেই নিরুদ্দেশ নেতার বিলাসী জীবন

শংকর কুমার দে ॥ হঠাৎ অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সেই সালাহউদ্দিন আহমেদ এখন কোথায় কেমন আছেন তার খোঁজ নিয়েছেন গোয়েন্দারা। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এক গেস্ট হাউসে রাজকীয় হালে জীবন যাপন করছেন সেই বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে রহস্যের জন্ম দেন তিনি। অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে তার বিদেশ বিভুইয়ে রাজকীয় কায়দায় বিলাস বহুল জীবন যাপনের অনেক অজানা কাহিনী। গোয়েন্দা সূত্র জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারিতে দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ-হরতাল ঘোষণা দেয়ার পর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বিবৃতি প্রদান করতেন বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে রাজনৈতিক দৃশ্যপটসহ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বিএনপির সেই সালাহউদ্দিন আহমেদের নামটি যেন পাদ প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতোই আলাপ-আলোচনা থেকে বাদ পড়ে গেছে। অথচ তার নাম নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সনসহ নেতৃবৃন্দ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও। গেল ৫ জানুয়ারি বিএনপি দলীয়ভাবে পালন করল। কিন্তু কোথাও সালাহউদ্দিনের নাম নেই। ২০১৫ সালে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে তার নামে বিবৃতি ছাপা হলেও এখন তার দলের কোন আলোচনায়ও নেই সেই বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। তখন ঘোষিত লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর ধারাবাহিকতা রক্ষায় পুলিশী গ্রেফতার এড়ানোর জন্য অজ্ঞাত অবস্থানে থেকে কর্মসূচী ঘোষণা করতেন তিনি। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারির দিনটিও সভা-সমাবেশ করে পালন করেছে বিএনপি ও সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু তার নামটি কোন আলোচনায় ছিল না। আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে বিবৃতি প্রদানকারী সেই বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এখন কোথায় কেমন আছেন তার খোঁজ নিয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বের হয়ে আসা তথ্যে জানা গেছে, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ ভারতের মেঘালয়ের শান্ত নিবিড় পরিবেশে অবস্থিত ‘সানরাইজ গেস্ট হাউস’-এ অবস্থান করছেন। দ্বিতল বিশিষ্ট এই গেস্ট হাউসে ফার্নিচারে সুসজ্জিত। নয়নাভিরাম ড্রয়িং রুম। চারটি বেডরুম, ফ্লাশ বাথরুম, লাইব্রেরি। এই গেস্ট হাউসটির সামনে সজ্জিত নানা প্রজাতির গাছগাছালি রয়েছে। সুনসান নীরবতায় মনোরম পরিবেশে বসবাস করছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ মামলার মোকাবেলা করছেন তিনি। বিএনপির আন্দোলনে, সুসময়ে, দুঃসময়ে মুখপাত্রের ভূমিকা পালনকারীদের একজন হিসেবে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ গোপন জায়গায় অবস্থান করে দিনের পর দিন আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে তার নামে বিবৃতিও ছাপা হতো। অথচ সেই সালাহউদ্দিন আহমেদ এখন কোথায়? মাত্র এক বছর শেষে আলোচনায় নেই তিনি। কেউ খোঁজও রাখেন না তার। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি যখন দেশব্যাপী লাগাতার হরতাল-অবরোধ ঘোষণা করেন তখন ঘোষিত লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর ধারাবাহিকতা রক্ষায় পুলিশী গ্রেফতার এড়ানোর জন্য অজ্ঞাত অবস্থানে থেকে কর্মসূচী ঘোষণা করে আসছিলেন তিনি। তার আগে দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী। পরবর্তীকালে ৩০ জানুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর বারিধারার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় রুহুল কবির রিজভীকে। রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার পর দলটির মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয় আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদের ওপর। সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যে গত ১০ মার্চ উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ হন সালাহউদ্দিন। সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার পর বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ শুরু পর্ব চলে অনেক দিন। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় সালাহউদ্দিন আহমেদ সরকারের কাছেই আছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমেদ র‌্যাবের কাছেই আছে আর এ প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। তাই অবিলম্বে তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’ সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমদ তখন বলেন, আমাদের এক দাবি যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই সালাহউদ্দিনকে নিয়ে গেছে। তাই তাদেরই দায়িত্ব তাকে আদালতের সম্মুখে-আমাদের সবার সম্মুখে হাজির করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেন, তার (সালাহউদ্দিন) বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। আমরা তাকে এ্যারেস্ট করার জন্য খুঁজছি। সে কোথায় তার জবাব দিতে পারবেন খালেদা জিয়া। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল (তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) বলেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমেদ আগেও লুকিয়েই ছিলেন। তিনি আমাদের কাছে নেই, আমরা চেষ্টা করছি আসলে কি ঘটেছে তা জানার জন্য।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম থেকেই তাকে খুঁজছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, বিএনপির এসব দাবিকে অস্বীকার করে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয় সালাহউদ্দিন আহমেদ নিজে নিজেই নিখোঁজ রয়েছেন। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে বিবৃতি দিচ্ছিলেন। কিন্তু সবাই জানে তিনি (খালেদার গুলশান কার্যালয়) থেকে বিবৃতি দিচ্ছিলেন। তাকেও কোথাও পাচার করা হয়েছে কি না সে জবাব খালেদা জিয়াই ভাল দিতে পারবে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, সরকারী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারূপ যখন চলছিল তখন বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। তার অন্তর্ধান হওয়ার পর ২ মাস ২ দিন পর কেটে গেছে তখন। হঠাৎ করেই গত ১১ মে দৃশ্যমান হন তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের গলফ লিঙ্ক এলাকায়। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করে তাকে। উদ্ধারের পর ছবিতে প্রথমদিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলেন বিএনপির এই নেতা। মেঘালয়ের গেস্ট হাউসে বসবাসকারী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ অসম থেকে প্রকাশিত-সহ ভারতে প্রকাশিত একটি বাংলা ও তিনটি ইংরেজী পত্রিকা নিয়মিত কিনে পড়েন। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছেন তিনি। সেখানে তার সঙ্গে রয়েছেন ব্যক্তিগত সহকারী, ম্যানেজার ও দুইজন তত্ত্বাবধায়ক। একেবারে বলা যায় রাজকীয় হাল হকিকতে বসবাস। তবে কিডনি ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন বিএনপির এ নেতা। ফলে সেখানকার একটি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাকে। আদালতের অনুমতি না থাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য শিলংয়ের বাইরেও যেতে পারছেন না তিনি। বাংলাদেশ থেকে প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে কেউ না কেউ শিলং যাচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন তার শারীরিক খোঁজখবর নিতে কেউ বা রাজনৈতিক কারণে। সময় পেলেই তিনি দেশের রাজনৈতিক অবস্থার খোঁজখবর নেওার চেষ্টা করেন। তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন, তিনি সেখানে যাচ্ছেন আসছেন। সালাহউদ্দিন কবে দেশে ফিরছেন তা অনিশ্চিত। তবে মামলা মোকদ্দমার ঝুট ঝামেল মিটিয়ে খুব দ্রুতই দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ।
×