
ছবি: সংগৃহীত
নব্বই দশকের এক সময়ের কথা। ফরিদপুর খ্রিস্টান মিশনের মধ্যে ছিল একটি মনোরম বাড়ি। আমি তখন ফরিদপুর জেলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। বাংলা ব্যান্ড সংগীত তখন বেশ জনপ্রিয়—প্রায় প্রতিদিনই শুনতাম, আর কিছু শিল্পীর প্রতি এমন টান ছিল যে, মনে মনে কল্পনা করতাম আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাচ্ছি। নিছক এক কিশোরের স্বপ্ন!
সেই স্বপ্ন থেকেই গিটার শেখা শুরু করি একজন গুরুর কাছে, যাকে আমরা “রুদ্র দা” বলে ডাকতাম। শেখার এক মাস পার হয়েছে, একটু একটু করে বাজাতে শিখে গেছি। রুদ্র দার বাড়িটা ছিল যেন এক টুকরো বাগানবাড়ি, নানান রকম গোলাপ গাছে ভরা। প্রতিটি গাছের প্রতি তাঁর ছিল দারুণ ভালোবাসা, নিজ হাতে যত্ন করতেন।
আমি ছিলাম দাদার প্রিয় ছাত্র। কারণ, অন্যদের গিটারের তার ছিঁড়লেও আমারটা খুব কম ছিঁড়তো। দাদা বলতেন, “তুই মন দিয়ে গিটার শিখিস, তাই তোকে আলাদা লাগে।”
একদিন এক মধুর বিকেলের কথা। বাগানের সবচেয়ে সুন্দর লাল গোলাপটি দেখে মনটা ভরে গেল। দাদাকে বললাম, “দাদা, কেন যেন মনে হয়, এই গোলাপটা শুধু আমার জন্যই ফুটেছে!”
দাদা হেসে বললেন, “ওটা আমার প্রিয় ফুল, কিন্তু আজ তোর জন্য দিয়ে দিলাম—এই প্রথম কাউকে অনুমতি দিলাম ফুল ছিঁড়তে।”
খুশিতে মন ভরে গেল। দৌড়ে গিয়ে গোলাপটা ছিঁড়ে ফেললাম। ঠিক তখনই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ে চিৎকার করে উঠলো, “ইডিয়ট! বদমাশ! ইতর!”
আমি হতভম্ব। এত সুন্দর মেয়ের মুখ থেকে এমন কটু ভাষা—এ জীবনে প্রথম শুনলাম! কিছু না বলে গিটার শেখার রুমে ফিরে এলাম।
ততক্ষণে দাদা সব শুনে ফেলেছেন। তিনি সেই মেয়েটিকে ডাকলেন, জানলাম সে তাঁর একমাত্র আদরের বোন। রাগে দাদা কষে কয়েকটা চড় কষালেন তাকে। আমি থামাতে চাইলেও কোনো কাজ হলো না। সেদিন বুঝলাম, দাদার রাগ কতটা ভয়ানক হতে পারে।
সেই ঘটনার পর থেকে, দাদা বাড়িতে না থাকলে আমাদের গেটের বাইরেই অপেক্ষা করতে হতো। আগে যেভাবে রুমে ঢুকে দাদা না আসা পর্যন্ত গিটার শেখার জন্য অপেক্ষা করতাম, সেই দিনের ঘটনার পর থেকে আর সম্ভব হয়নি।
হায়, অভাগা গোলাপফুল, তোর কারণেই হারালাম দু’কূল...
এই লেখাটি আমার গিটার শেখার শুরুর দিনগুলো, আমার গুরুর প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা থেকে লেখা। গুরুর প্রকৃত নাম এখানে উল্লেখ করিনি, কিন্তু আজও তিনি আমার হৃদয়ের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাতেই রয়েছেন।
মুমু ২