
ছবি: জনকণ্ঠ
ইতিহাসের সাক্ষী, সভ্যতার বাতিঘর—আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যার গম্বুজের নিচে প্রজ্বলিত হয়েছে জ্ঞানের দীপশিখা, যার দেয়াল জুড়ে প্রতিফলিত হয়েছে মুসলিম বিশ্বের চিন্তা ও আত্মার আলোকছায়া। সেই মহিমান্বিত আল-আজহারের ইসলামি আইন বিভাগে আজ ছিল অনুভূতির জোয়ারে ভাসার দিন। শেষ হয়েছে অনার্স প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা। দীর্ঘ অধ্যয়নের নিঃসীম পথ পেরিয়ে ছাত্রদের চোখে-মুখে এখন প্রশান্তির দীপ্ত আলো।
মঙ্গলবার, ২৪ জুন—দিনটি যেন পরিণত হয়েছে এক আবেগঘন অধ্যায়ের শেষ পৃষ্ঠায়। যাত্রা ছিল ক্লান্তিকর, রাতভর জেগে থাকা, বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাওয়া, এবং পরীক্ষার হলরুমে নীরব ঘাম ঝরানোর। সেই অধ্যায়ের আজ পরিসমাপ্তি। তাই ছাত্রদের মুখে এখন যেন বিজয়ের হাসি, হৃদয়ে স্বস্তির দীর্ঘ শ্বাস।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি করিডোর, প্রতিটি সিঁড়ি, এমনকি খেজুরগাছের পাতায় পাতায় লেগে থাকা বাতাসে পর্যন্ত ছিল বাঁধভাঙা আনন্দের দোলা। সামনে দীর্ঘ তিন মাসের ছুটি—এই ছুটি কেবল অবসরের নয়, বরং শিকড়ে ফেরার প্রতীক্ষা। অনেকেই ইতোমধ্যে কনুইতে ট্রলি ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাতে পাসপোর্টের খাম নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন কায়রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইটের জন্য। সেই টিকিটে লেখা শুধু গন্তব্যের নাম নয়, লেখা আছে মায়ের হাতের ভাতের অপেক্ষা, বাবার গলার ডাক, আর প্রিয় মসজিদের মিনারে ভেসে আসা তাকবিরের সুর।
বাংলাদেশি ছাত্ররা এই মরুর দেশে যেন বাংলার সবুজের প্রতিনিধি। তাদের চোখে এখন নিজভূমির ঝাপসা জলছবি। কায়রোর ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটলেও তারা যেন খুঁজে ফেরে গ্রীষ্মের দুপুরে গ্রামের মেঠোপথ। আর যখন পরীক্ষা শেষ, ক্যাম্পাসের ঐতিহাসিক গেটের সামনে তোলা শেষ ছবিগুলো তখন পরিণত হচ্ছে স্মৃতির অমূল্য ফ্রেমে।
লাইব্রেরির ধুলোমাখা সিঁড়িতে বসে কেউ হয়তো রেখে যাচ্ছে জীবনের এক ছোট অধ্যায়, কেউ আবার ক্যামেরায় বন্দি করছে সেই মুহূর্তগুলো—যা একদিন ফেসবুক টাইমলাইনের কিংবা অ্যালবামের পাতায় ফিরে এসে মনে করিয়ে দেবে প্রবাসের দিনগুলোর কষ্ট আর গৌরবের কথা।
একজন ছাত্র বলেন, “মায়ের হাতের গরম ভাত, মাছভাজা, শুঁটকির ঝাল—এসব যেন মনে হত স্বপ্ন। এখন মনে হচ্ছে খুব কাছেই। এবার ঈদের সকালে উঠানের ধুলো মাড়িয়ে বাবার ডাক শুনেই ঘুম ভাঙবে। পুরনো মসজিদের মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আবার শুনবো তাকবির।”
আল-আজহার শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়—এটি আত্মার প্রশান্ত ঘর, মননের আশ্রয়। এখানকার প্রতিটি ক্লাস, আলোচনা, এমনকি দীর্ঘ পরীক্ষা সবই গেঁথে গেছে ছাত্রদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে। এখানেই তৈরি হয়েছে আত্মিক ঘনত্ব, গড়া হয়েছে চিন্তার ভিত।
আজকের দিন তাই কেবল একটি পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন নয়। এটি একটি পর্বের অন্তিম বেলাভূমি, আরেক নতুন পথচলার উন্মোচন। ছাত্রদের আনন্দে-ভেজা চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিদায়ের মৃদু কষ্ট যেন বলে দিচ্ছে—এই অধ্যায় একদিন হয়ে উঠবে গল্প, স্মৃতির পাতায় ফিরে দেখা এক নরম ছবি।
আর সেই গল্পে থাকবে আজকের দিনটির নাম—যেদিন আল-আজহার কাঁপছিল আনন্দের হাওয়ায়, আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের হৃদয়ে বাজছিল মাটির গন্ধ মেশানো এক অদৃশ্য সুর।
সাব্বির