
একটা সময় ছিল, যখন মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল সমাজে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা ছিল প্রায় নিষিদ্ধপ্রায়। পারিবারিক ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বন্দি নারীরা শিক্ষার আলো দেখতে পারতেন না বললেই চলে। তবে সেই কঠিন বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে এক সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি আরব সরকার।
নানা জল্পনা-কল্পনা, বিতর্ক ও সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটিয়ে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সৌদি আরবের প্রথম নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—মহিলা শিক্ষা কলেজ। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ছিল না, বরং নারীদের আত্মপরিচয়, ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার অধিকারের এক ঐতিহাসিক ভিত্তিপ্রস্তর।
এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে নারী শিক্ষা নতুন দিগন্তে পা রাখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান বিস্তৃত হয়ে গড়ে ওঠে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থায়। সেই ধারারই পরিণত রূপ আজকের প্রিন্সেস নূরা বিনত আবদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়—বিশ্বের সর্ববৃহৎ নারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত।
এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সৌদি নারীদের নয়, বরং গোটা মুসলিম বিশ্বের নারী শিক্ষার জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আধুনিকতা, প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব সমন্বয়ে নির্মিত বিশাল ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে নারী শিক্ষার উপযোগী সর্বাধুনিক অবকাঠামো। ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করেছে—নারীরাও মর্যাদা ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখেই উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্ব দিতে পারে।
প্রতিষ্ঠার প্রথম ২৫ বছরের মধ্যেই সৌদি আরবজুড়ে ৭২টি শহরে গড়ে ওঠে ১০২টি মহিলা কলেজ, যেখানে অধ্যয়ন করতেন প্রায় ৬০,০০০ ছাত্রী। শুধু রিয়াদেই ছিল ছয়টি কলেজ, যা পরিচালিত হতো শিক্ষা, সমাজসেবা, বিজ্ঞান, কলা ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগে।
২০০৪ সালে রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত সকল মহিলা কলেজকে একীভূত করে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৮ সালে তৎকালীন বাদশাহ ও দুই পবিত্র মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করেন তাঁর বোনের নামে—প্রিন্সেস নূরা বিনত আবদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়।
‘নূরা’ শব্দটি আরবিতে ‘আলো’র প্রতীক, যা নারীশিক্ষায় আলোকিত এক নতুন যুগের সূচনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেক্টর নিযুক্ত হন প্রিন্সেস আল জাওহারা বিনত ফাহাদ আল সৌদ।
মাত্র দুই বছরে সম্পন্ন হয় বিশাল এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ, যাতে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় ৭৫,০০০ শ্রমিক। বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন ১৩ মিলিয়ন বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যেখানে একসঙ্গে ৬০,০০০ ছাত্রী অধ্যয়ন করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে:
৬০০ স্মার্ট বিল্ডিং
আধুনিক ছাত্রাবাস
গবেষণা কেন্দ্র ও গ্রন্থাগার
বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল
ছাত্র সহায়তা কেন্দ্র
স্পোর্টস কমপ্লেক্স ও ইনডোর অ্যাকটিভিটি হল
স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা (প্রি-স্কুল থেকে হাই স্কুল)
স্বয়ংক্রিয় মেট্রো রেল (Hitachi Rail Italy নির্মিত)
আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার
শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য রয়েছে অলিম্পিক মাপের সুইমিং পুল, বাস্কেটবল, ভলিবল, সাইক্লিং ও অ্যারোবিকসের আলাদা হল।
২০১৭ সালে প্রিন্সেস নূরা বিশ্ববিদ্যালয় সৌদি আরবে প্রথমবারের মতো আয়োজন করে একটি অপেরা শো—“আন্তার ও আলবা”, পরিচালনায় ছিল Opera Lebanon। এটি সৌদি সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
২০১৬ সালে সৌদি আরবের ক্রীড়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে, যার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে নারীদের ক্রীড়া অংশগ্রহণ ৪০%-এ উন্নীত করা।
বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে পরিবেশবান্ধব ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি:
পানি পুনঃব্যবহার প্লান্ট
সৌর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
৪,০০০ বর্গমিটার সৌর প্যানেল (যা ১৬% হিটিং ও ১৮% শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক)
৩৮টি ভবন LEED (Leadership in Energy and Environmental Design) রেটিংয়ের জন্য মনোনীত
গ্রন্থাগারটি LEED Gold রেটিংয়ের জন্য আবেদন করেছে
বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এর আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে:
University of Auckland (নিউজিল্যান্ড)
University of Southern (ডেনমার্ক)
Valencia College (যুক্তরাষ্ট্র)
Rouen University (ফ্রান্স)
Erasmus University (নেদারল্যান্ডস)
Monash University (অস্ট্রেলিয়া)
Dublin City University (আয়ারল্যান্ড)
প্রিন্সেস নূরা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়—এটি সৌদি নারীদের জাগরণের প্রতীক। এটি প্রমাণ করে, সুযোগ পেলে নারীরাও হতে পারে আধুনিক, সচেতন, দক্ষ এবং নেতৃত্বদানে সক্ষম। আজ এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে—ইসলামি মূল্যবোধের মধ্যে থেকেও নারীরা উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্ব দিতে পারে, আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস বজায় রেখেই।
ফরিদ