ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

যোগ-বিয়োগ

অঞ্জন আচার্য

প্রকাশিত: ২২:১৫, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

যোগ-বিয়োগ

রতন আর আমি একই স্কুলে পড়তাম, একই ক্লাসে

রতন আর আমি একই স্কুলে পড়তাম, একই ক্লাসে। হাবাগোবা টাইপের। প্রতিবারই ফেল করত অঙ্কে, ইংরেজিতে, সমাজ ও বিজ্ঞানে। আমার সঙ্গে ছিল তুই-তোকারি সম্পর্ক। আমাকে সম্বোধন করত ‘বন্ধু’ বলে। অথচ আমরা কেউ কারও বন্ধু ছিলাম না। সে কথা আমি যেমন জানতাম, সেও জানত হয়তো। তবুও, ক্লাসের কিছু সহপাঠী এমন থাকে- যারা ঠিক বন্ধু নয়, এক অর্থে কিছুই নয়। তুই সম্পর্কটাও ঠিক নৈকট্যের জোরে হতো না, আসত অকারণ অভ্যাসে।
আমি ও রতন বিজ্ঞান ও অঙ্ক করতে যেতাম হাফিজ স্যারের বাসায়। নতুনবাজার মোড়ে ছিল রতনদের বাসা। মাঝপথে গাঙ্গিনারপাড় থেকে আমি ওর সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠে বসতাম। আমাকে পেছনে বসিয়ে সে দিব্যি পাটগুদাম চলত। সকাল আটটার মধ্যে হাফিজ স্যারের বাসায় যেতে না পারলে সেদিনের পড়া আর হতো না। তাই আগে থাকতেই অস্থির হয়ে আমি স্টুডিও গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
ওটা প্রাক-মোবাইল যুগের কথা। রতন আসবে কি আসবে না, এলেও যথাসময়ে আসবে কি না, সেটা আগে থেকে জানার কোনো উপায় ছিল না। সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। এর মধ্যে যদি রতন না আসত, তখন রিকশা নিতাম। দুই টাকা খরচ হতো।
একদিন রতন ক্লাসে আসে না, হাফিজ স্যারের বাসাতেও পড়তে যায় না। আমি দু-তিন ঘণ্টা ওর জন্য অপেক্ষা করে করে একা একাই স্যারের বাসায় যাই। এভাবে এক মাস, দুই মাস, ছয় মাস, এমনকি ফাইনাল পরীক্ষার আগেও তার দেখা মেলে না। আমরা কেউ রতনের জন্য চিন্তিত হই না, কিংবা বলতে গেলে ভুলেই যাই তার কথা। একদিন হঠাৎ শচীন আইচ স্যার পড়ার ফাঁকে জিগ্যেস করেন, রতন আসে না কেন রে, তোরা কেউ বলতে পারিস?
আমরা কেউ বলতে পারি না।
রতনদের পড়াতেই থাকত কাজল সাহা। টিফিন পিরিউডে সেদিন কাজলকে জিগ্যেস করি, কী রে, রতন স্কুলে আসে না কেন রে? প্রতিত্তোরে বলল, ও শেষ! বলেই রহস্যময় চোখে আমার দিকে তাকায়।
কাজলের কথার কোনো মাথামু-ু বুঝি না। শুধু হা মুখ করে বলি, সব শেষ মানে?
কাজল আমাদের ক্লাসের সেকেন্ড বয়। দারুণ ব্রেন। অঙ্কে তো সবার সেরা। গাণিতিক ভাষায় সে বলল, মার্ডার।
শব্দটি যে ভয়ঙ্কর, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না। তবে মানুষ কেন খুন হয়, ক্লাস সেভেনে পড়া এই আমার মাথায় সেই অঙ্ক মেলে না। মানুষ কেন মরে যায়, তাও অজ্ঞাত থাকে। বুঝলাম, অনেক কিছুই আমার জানা নেই। কোনো এক অদ্ভুত কারণে, আমি তখন লতার কথা ভাবতে থাকি। তাকে বউ হিসেবে পেলে কী করব, সেটাই কল্পনায় ভাসাই।
লতা ছিল আমাদের লতায়-পাতায় আত্মীয়। একদিন সন্ধ্যায় ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে সে গলায় ফাঁস দেয়। বাসায় পুলিশ আসে। সবাইকে জেরা করে। আমাকেও কী যেন জিগ্যেস করেছিল, মনে নেই।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, তা জানার খুব আগ্রহ হয়। কিন্তু সেই উত্তর আমার জানা হয় না। অনেকদিন পর জানতে পারি, লতার পেটে বাচ্চা ছিল। বাচ্চা কীভাবে পেটে আসে, সেই ধারণাও ছিল ধর্মগত, অপার্থিব।
এতকাল পর রতন বা লতার কথা কেন বলছি, তা জানি না। সেই যে রতন স্কুল থেকে হারিয়ে গেল, এরপর আর দেখা হলো না তার সঙ্গে। লতার সঙ্গেও সাক্ষাৎ হওয়ার আর কোনো সুযোগ রাখেনি সে নিজেই।
সেদিন রাতে রতন ও লতাকে স্বপ্নে দেখি। বর বেশে রতন, কনের সাজে লতা। আমার বাসায় আসে। একসঙ্গে চা-নাস্তা খায়। তারপর চলে যায়। স্বপ্নে রতন ও লতার বিয়ে দিয়ে আমার ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে?

×