ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তনু কায়সার

আমি তখনই লিখি যখন আমার কাছে তা অপরিহার্য মনে হয়

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৪ মার্চ ২০১৬

আমি তখনই লিখি যখন আমার কাছে  তা অপরিহার্য মনে হয়

চিরাচরিত প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। আপনার লেখালেখির শুরু সম্পর্কে আমাদের বলুন। লেখালেখির শুরু অনেক আগে, যখন আমি স্কুলে পড়তাম। তখন পূর্বদেশ বলে একটা পত্রিকা ছিল। তোমরা তো সেই পত্রিকা দেখনি। পূর্বদেশ ঢাকা থেকে বের হতো। চট্টগ্রামের পূর্বদেশ নয়। ১৯৬৪ সালের দিকের ঘটনা। একটা কবিতা ছাপা হয়েছিল সেই পূর্বদেশ পত্রিকায়। অনেক আগের কথা। কবিতার বিষয় কী ছিল মনে নেই। তখনও আমি সিরিয়াসলি লেখালেখিটা নিইনি। পরে আমি যখন ১৯৬৬ সালের দিকে ঢাকা কলেজের ছাত্র, তখন লেখালেখি সিরিয়াসভাবে শুরু করি। তারপর থেকে নিয়মিত লিখছি। বিভিন্ন রকম লেখা লিখতাম। যখন যা মাথায় আসত তাই লিখতাম। মনে হলো গল্প লিখব, গল্প লেখা শুরু করলাম। মনে হলো এই বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা দরকার প্রবন্ধ লিখলাম। নির্দিষ্ট করে কোন বিষয়কে সামনে নিইনি। আপনি তো প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, নাটক ইত্যাদি লেখেন। কোন্্ শাখায় লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বেশি? স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা বিষয় নয়। আমি তখনই লিখি যখন আমার কাছে তা অপরিহার্য মনে হয়। আমার এ লেখাটি লিখতে হবে, না লিখে উপায় নেই; তখনই লিখতে বসি। সেটা গল্প হোক, প্রবন্ধ হোক বা কবিতাই হোক। এখন কি আগের মতো কবিতা লেখেন? জীবনের প্রথম লেখাটা তো কবিতাই লিখেছিলাম। আগের মতো ওই অর্থে আর কবিতা লেখা হয় না। তবে কবিতার প্রতি আমার অন্যরকম একটি টান এখনও আছে। এবার যখন ব্যাঙ্গালুরে গেলাম তখন মুহম্মদ নূরুল হুদা, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক আমাদের টিমে ছিলেন। তখন ওঁরা আমাকে কবি হিসেবে ব্যাঙ্গালুরে পরিচয় করে দিয়েছিল। সেখানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও ছিল। আমার প্রথম কবিতার বই ‘রাখালের আত্মচরিত’ ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে দুই দশক গ্যাপ দিয়ে দ্বিতীয় কবিতার বই বের করেছি। এখন কবিতা ঐভাবে লেখা হয় না। সেটা হয়ত ব্যস্ততার জন্য। কবিতার জন্য যে অবকাশ প্রয়োজন তেমন অবকাশ পাচ্ছি না। যখন বিভিন্ন দিক থেকে অবসর পাব তখন হয়ত আবার কবিতার দিকে পা বাড়াব। কবিতা লিখে আমি অনেক আনন্দ পেয়েছি। আমার ‘অন্তিম যাত্রার প্রস্তাব’ বলে একটি কবিতা আছে। এই কবিতাটি এখনও আমাকে আনন্দ দেয়। আপনার প্রবন্ধের মধ্যে একটা অন্যরকম স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায়... সেটা হয়ত আমার লেখার ধরনের কারণে। সাহিত্যের নানা বিষয় আশয়ে আমার বসবাস। আমি যখন লিখি ফর্মটা আমার প্রয়োজনের জন্য আমি সৃষ্টি করি। সেই ফর্মে লিখতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। একটা উদাহরণ দেই। আমার ‘তৃতীয় মীর’ বইটার কথা বলি। এটা একটা প্রবন্ধের বই। কিন্তু এটা যখন তুমি পড়বে, তখন তোমার কাছে এটা প্রবন্ধের বই বলে মনে হবে না। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের যে আনন্দ, যে স্বাদ, যে চিন্তা সেটা কিন্তু তুমি ‘তৃতীয় মীর’-এর মধ্যে পাবে। এটা আমার জন্য একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। এই কাজটা আমার খুব প্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের কাছেও বইটি সমাদৃত। আমি সেখানে ‘তৃতীয় মীর’-এর লেখক হিসেবে পরিচিত। অনেকেই এই বইটিকে কেবল প্রবন্ধের বই বলেন না। এই ফর্মে লিখতে আমার প্রচুর সময় লেগেছে। কিন্তু আমি অনেক আনন্দ পেয়েছি। তৃপ্তি পেয়েছি। এ জন্য আলাওল পুরস্কারও পেয়েছিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে ‘প্রথম আলো’ লিখলেন, সেখানেও তাঁকে এই বইটি সাহায্য করেছে। আপনি অনেক জায়গায় অনেকবার বলেছেন : সাহিত্য চর্চায় সিরিয়াস হতে হবে... তোমাকে এ প্রসঙ্গে আগে ঋত্বিক ঘটকের কথাটা বলি। ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, পুতু পুতু প্রেম অর্থহীন। সাহিত্য কোন ঢংয়ের বিষয় নয়। সাহিত্য সিরিয়াস বিষয়। দশ লাইনও যদি লেখ তাহলে তা সিরিয়াসভাবেই লিখতে হবে। যা বিশ্বাস করো তার প্রতি তুমি বিশ্বস্ত থাকবে। বাকি কিছু তোমার মনে রাখার প্রয়োজন নেই। তাহলে দেখবে সাহিত্য তোমাকে তোমার পথে নিয়ে যাবে। আমি অন্তত এটা মনে করি। আমাকেও অনেক বৈরিতা অতিক্রম করতে হয়েছে। আমি এসব বিষয়-আশয় পার হয়েই এখন পর্যন্ত লিখছি। আপনার প্রিয় লেখক কারা? আমার প্রিয় লেখক অনেকেই আছেন। শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত আলীকে পড়ি। ভাল লাগার কি শেষ আছে। প্রিয় লেখকদের তালিকা বলে তো শেষ করা যাবে না। আবার আমি তরুণদের লেখাও আগ্রহভরে পড়ি। একটা সময় প্রচুর পড়তাম। এখন চোখের সমস্যা তো আছেই। তাই বাধ্য হয়েই পছন্দের বইগুলোই পড়তে হচ্ছে। তারপরও আমি তরুণদের লেখা পড়ি। কারণ এর মধ্য দিয়ে আমি বর্তমানের তরুণরা কী ভাবছে, কী পরিবর্তন হচ্ছে সাহিত্যেরÑ তা জানতে পারি। সমকালীন সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে কী বলবেন? সমকালে যারা সাহিত্য চর্চা করছে তাদের একটা নেতিবাচক দিক আছে। সেটা হচ্ছে এখনকার তরুণরা অনেকেই এখনকার লেখাই কেবল পড়ছেন। কিন্তু আগের লেখকদের লেখা তারা পড়ছেন না। ক্লাসিক সাহিত্য সম্পর্কে ঐ অর্থে তাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। অনেকেই হয়ত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বা শহীদ কাদরী বা শামসুর রাহমানই পড়ছে না। এটা একটা ক্ষতিকর ব্যাপার। কেননা, সাহিত্যের ধারাক্রম জানাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি যদি নতুন কিছু করতে চাই তবে পুরাতন বা অতীতকে জানতে হবে। অতীতকে না জেনে তো নতুন কিছু করা সম্ভব নয়। আগে জানতে হবে সাহিত্যে এমন এমন কাজ কী বা কোথায় হয়েছে। তারপর এর বাইরে গিয়ে লেখার চেষ্টা করতে হবে। তবে তরুণদের চেষ্টা ও উদ্দীপনা আমার কাছে ভাল লাগে। লেখকের সামাজিক দায় প্রসঙ্গে কিছু বলুন। লেখক যিনি হবেন তাকে সৎ হতে হবে। লেখকের সামাজিক দায় অবশ্যই আছে। তবে সেটা ঐরকম অর্থে নয়। বলে কয়ে তো সাহিত্যে দায়িত্ব পালন হয় না। লেখক যদি সৃষ্টিশীল হয়, সৃজনশীল হয়, তিনি যদি জীবন থেকে উপকরণ নেন, মৃত্তিকাঘনিষ্ট হন তবে তার লেখায় সামাজিক বিষয় আশয় উঠে আসবেই। ক্ষুদ্রার্থে নয়Ñ সূক্ষ্ম অর্থে, শৈল্পিক অর্থে, বৃহৎর অর্থে লেখকের সামাজিক দায় আছে। আপনার শৈশব জীবন তো চাঁদপুরেই কেটেছে... হ্যাঁ। আমার শৈশব কেটেছে চাঁদপুরেই। আমাদের বড়স্টেশনের কাছে বাসা ছিল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কিন্তু আমি চাঁদপুরে ছিলাম। এখানে আমি বেড়ে উঠেছি। সবশেষে পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলুন। জীবনের বিচিত্র সময়ে বিচিত্র রকম লেখা আমি লিখেছি। সেই যে ’৬৬/৬৭-র দিকে লেখালেখি শুরু করলাম, সেটা এখনও অব্যাহত আছে। যতদিন বাঁচি লেখালেখি অব্যাহত রাখতে চাই। পাঠকরা আমার সঙ্গে ছিলেন। অনেক পাঠক উৎসাহ দিয়েছেন। ভাল-মন্দ জানিয়েছেন। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আর হ্যাঁ, ভাল পাঠক হওয়াও একটা বড় বিষয়, একটি ভাল অর্জন।
×