ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাশ্বত হাসান

কালো কাকের ছানা

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ২১ মে ২০২২

কালো কাকের ছানা

ওহা! ওহা! ওহা! যেন শিশুটি আকাশ থেকে নেমে এসেছে। তাই সে উপর দিকে হাত-পা ছুড়ছে। তার বাবা মার কোন পরিচয় নেই। কমলাপুর রেল স্টেশনের দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত মাঠ। পূর্ব দিকে মুগদাপাড়া, এখান থেকে দক্ষিণ দিকে রেল সড়ক সমান্তরালভাবে ছুঁয়েছে নারায়ণগঞ্জের উত্তর প্রান্তে চাষারা রেল স্টেশন। কমলাপুর থেকে মিটার গেজের অন্য রেল লাইনটি উত্তরবঙ্গের দিকে, অপর শাখা টঙ্গী থেকে চট্টগ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেক দুঃখ, অনেক সুখের স্মৃতি নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনটি। এখান থেকে রেলযোগে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই যাওয়া যায়। তাই স্টেশনের প্লাটফরমে সব সময় মানুষের ভিড় থাকে। স্টেশনজুড়ে দিনে কুলি-মজুরদের হাঁকডাক আর রাতে প্রেতপুরীর নির্জনতা নামে। রেলগাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় লাল জামা পরা কুলিদের হুড়াহুড়ি। মাঝে মাঝে যাত্রীদের বোঝা নিয়ে টানাটানি লাগে এ মানুষগুলোর। এরই মাঝে কুলি সর্দারের চড়-থাপ্পড় শপাং শপাং ঝলসে ওঠে খেটে খাওয়া এই প্রাণীগুলোর ওপর। সে আঘাতে পিঠের জ্বালা আর পেটের জ্বালা এক হয়ে ভিন্ন ধরনের জ্বলানি আরম্ভ হয় ওদের হৃদয়ে। দ্বিতীয় সমস্যা ওদের মাঝে অগোছাল হয়ে, সারাক্ষণ ভিড় করে থাকে এক ঝাঁক ভাসমান মানুষ। মানুষগুলো দেখলে অনেকের গেন্না লাগে। সন্ধ্যা হতেই কালো টায়ারে জ্বলে ওঠে ওদের হৃদয়ের আগুন। চালগুলো ফুটতে থাকে হাঁড়িতে। চোখ- মুখ লাল করে গাল ফুলিয়ে চুলায় ফুঁ দিচ্ছে পরিবানু। আর উদ্দেশ্যহীনভাবে বকছে...। Ñমরার আগুন জ্বলে না, পেটের আগুন জ্বলতাছে। অনেক রাত, জেগে আছে পরিবানু। এদিক ওদিক করে, কিছুতেই ঘুম আসে না তার। তীর ভেঙ্গে পড়া মাটির ঝুপ, ঝুপ শব্দ কানে বিঁধে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পদ্মার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। এখানেই ছিল তার বসতভিটা। সর্বনাশা পদ্মার বুকে স্বামীর কবর গেছে। কুমিরে গিলে খায় তার একমাত্র পুত্র জহিরুলকে। এখানে তার ফসলের মাঠ ছিল। গোয়ালে ছিল গরু আর বাছুর। এখানেই এককালে হাঙ্গর কুমিরেরা গড়েছিল নিজেদের আস্তানা। আজ আর ওখানে কুমির থাকে না। ওখানে জেগে উঠেছে নতুন বালুচর। সেই উন্মত্ত পদ্মা আর নেই। নেই তার ধলেশ্বরী ঢেউ। চৈত্রে দেখা যায় ধু-ধু বালি আর বালি, মরুভূমি। ঝাউ কাউনের গাছ নেই কোথাও। বক পাখিরা টোকায় না ছোট ছোট মাছ। গাংচিল ছোঁ মারে না ছিপখান নৌকার গলুইয়ের খুব কাছাকাছি। রাতের নির্জনতা ভেদ করে পরিবানুর কানে শব্দ আসে। ওহা! ওহা! ওহা! পরিবানু কাউকে দেখে না। এত রাতে শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে বিচলিত হয় সে। আন্দাজ করে, দক্ষিণ দিক থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। সারি সারি মানুষগুলোর লাশ পেরিয়ে পরিবানু এগুতে থাকে দক্ষিণের মাঠের দিকে। যেখানে কেঁদে মরছে নতুন শিশুটি। বিড় বিড় করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে- -কোন্্ অধম বাচ্চাডারে ফ্যালাইয়া গেল। পরিবানু নতুন বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। ফুটফুটে চাঁদের মতোন মুখ ওর। কিছুক্ষণের মধ্যেইে মায়ের আদরে শিশুটির কান্না থেমে যায়। ভাসমান মানুষগুলোর মধ্যে হৈচৈ পড়ে, শিশুটি কোন্ নরাধমের? সবারই চোখে এক ধরনের কৌতূহল। দিন যায়, মাস যায়, আর শিশুটি বড় হতে থাকে পরিবানুর কাছে। কুড়িয়ে পেয়েছে বলে- সে এর নাম রাখে ‘টোকাই’। গুড় মিশিয়ে আটার ল্যাই বানিয়ে দেয় টোকইর মুখে। টোকই আনন্দের সঙ্গে আটার ল্যাই খায়। পরিবানুর বুকে আর আনন্দ ধরে না। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে টোকাইয়ের দিকে। -সখিনা পান চিবুতে চিবুতে পরিবানুর খুব কাছে ঘেঁষে বসে। বলে- তর টোকাইর দেহি শইলডা মোডা মোডা অইছে। -দেহিস মুখ লাগবো, কালা ঠোলার দিকে চা। -ইস-সে-রে, কার না কার বেজন্মা পোলা। থুঁ ঘেœ-না লাগে! হাতের আঙ্গুল থেকে চুনে কামড় দেয় সখিনা। মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায় ওদের রস তামাশা। চেঁচিয়ে ওঠে পরিবানু -আমার টোকাইর দোষ কি? টোকাই কি আসমানতে আইছে। মানুষের পেডেততেনে অইছে। আহ-হারে সাধু! দেখছি না। জন্মের মাঝে কোন জাত-বেজাত দেখে না। পরিবানু শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে বলে, -বেজন্মা কারে কয়, জানস তুই? শিশুর নিশ্বাস। পরিবানুর গর্জনে স্টেশনের মানুষের ভিড়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকেই তলিয়ে দেখে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিও দাঁড় করে। কথাটি বলে বিপাকে পড়ে সখিনা। নরম কণ্ঠে বলে- -আমি কি দোষের কথা কইছি। খালি কইছি আহ-হা-রে পোলাডার বাবা মার পরিচয় নাই। বুজান, তুই আমার কথায় চেতলা ক্যান? -চেতমু না তো হোয়াগ করমু? চুমু দিমু? আমার এহেন তে যা, নাইলে ঝাড়ুদা দিমু-পোড়ামুখী। -হ, যাইতাছি। সখিনা রাগ থামাতে না পরিবানুর। আস্তে আ্েস্ত চলে যায় নিজের আস্তানার দিকে। আর ভাবে সারি সারি মানুষগুলো ক্যামনে মাথার নিচে ইট দিয়ে শুয়ে থাকে। ওর ভীষণ কষ্ট হয়। পরিবানুর কথাগুলো খুব বিচলিত করে তুলেছে ওকে। তারও তো কোন পরিচয় নেই। তবে কি তার বেলায়ও ইহাই সত্য। বিন্দুমাত্র মিথ্যার অবকাশ নেই। জন্ম শব্দটিও যেমন সত্য। তেমনি পৃথিবীতে প্রত্যেক শিশুই পবিত্র। টোকাই ও ছুটকো ওরা দুই বন্ধু। পথে পথে রাজপথে কাগজ, ফেনা পানির বোতল ইত্যাদি টোকায় তারা। সারাদিন ওরা অফিস-আদালত, কোট-কাছারির আশপাশে ঘোরে। মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটির আশপাশের এলাকাতেও ওদের কাগজ কুড়াতে দেখা যায়। মানুষের সৌন্দর্যও কুড়ায় তারা। দিন শেষে কমলাপুরে শিবু মহাজনের ভাঙ্গাড়ির দোকানে বস্তায় ভর্তি জিনিসগুলো বিক্রি করে ওরা। আয় বেশি না। দু’জনের আয়ে পরিবানুর সংসার ভালই চলে। পরিবানু মনে করে এই টোকাইই তার শেষ অবলম্বন। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন। দিকে দিকে মিছিল আর মিছিল ওইদিন মতিঝিলে শাপলা চত্বর দিয়ে একটা বড় আকারের মিছিল যাচ্ছিল বায়তুল মোকাররমের দিকে। শ্রমিক-কর্মচারীর মিছিল। ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দিবো রক্ত।’ হঠাৎ পুলিশী বাধা। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। টিয়ার গ্যাসে চারদিক অন্ধকার। দ্বিগি¦দিক ছুটেছে মানুষ। সরকারী দলের গুন্ডারা গুলি ছুড়েছে। ওদের দমন করতে সোনালী ব্যাংকের আট তলার ছাদ থেকে ইট বৃষ্টির মতো শুরু হলো। চলবে...
×