ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তির মিছিলে হাসান

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০

মুক্তির মিছিলে হাসান

সন্ধ্যার আকাশটা লাল হয়ে আছে। রক্তের মতো লাল। হাসান একটা কাঁচা আম হাতে নিয়ে বাড়ির সামনের ঝিলের ধারে আগাছার জঙ্গলে, গঙ্গাফড়িংয়ের সন্ধানে গেল। তার অন্য হাতে জিগা গাছের আঠা। পাটকাঠির মাথায় জিগার আঠা লাগিয়ে গঙ্গাফড়িং ধরে সে। মা-বাবা সারা দিন ঘর থেকে বের হতে দেয় না তাকে। মা-বাবা, বড় বোন সবাই ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শুধু তারাই না; গ্রামের সবাই নির্জীব। কেউ আর আগের মতো প্রাণ খুলে কথা বলে না। চারদিকে হাহাকার। বাবা বলেন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ। হাসান গঙ্গাফড়িং ধরতে ধরতে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় জঙ্গলে কিছু দেখতে পায় না হাসান। কিন্তু ফিসফিস আওয়াজ কানে আসে ওর। হাসান ভয় পেয়ে যায়। পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ একজন পেছন থেকে নাম ধরে ডাক দিল হাসানের। নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। ভয় ভয় চোখে পেছনে ফেরে হাসান। পিছু ফিরে একটা চেনা মুখ দেখে ভয় কেটে যায় ওর। এ যে উত্তর পাড়ার বলাই দা! হাসান এক গান হাসি মুখে এনে বালাইকে বলে ‘দাদা, তুমি এই জঙ্গলে কি কর? তুমি নাকি যুদ্ধে গেছ? বলাই হাসানের কাঁধে হাত রাখে। বলে- ভাই এখানে যে চারজনকে দেখতে পাচ্ছ, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। হাসান হা করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবার পরনে মলিন কাপড়। মুখভর্তি দাড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে কয়েকদিন খেতে পায়নি। তবে ওরা মুক্তিযোদ্ধা, শুনে বুকটা কেমন যেন গর্বে ফুলে ওঠে। হাসান অবাক হয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করে, কেন তারা এই জঙ্গলে? বলাই বলে- পাকিস্তানীরা সামনের পোড়াবাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে। আমরা ওখানে অপারেশেন করে ওদের মারতে চাই। না হলে ওরা আমাদের গ্রামে আক্রমণ করে সবাইকে মেলে ফেলবে। বলাই বলে- পাকিস্তানীরা চারদিকে পাহারা বসিয়েছে। আমরা বড়রা ওখানে গেলে ধরা পড়ব। মেরে ফেলবে আমাদের। কিন্তু ওখানে গিয়ে লুকিয়ে ওদের আক্রমণের পরিকল্পনার কথা জেনে আসতে হবে। তা হলে আমরা ওদের সহজে পরাজিত করতে পারব। হাসান তুই ছোটমানুষ। তুই পারিস ওখানে গিয়ে আমাদের খবর এনে দিতে। হাসান কিছু বুঝতে পারে না কি বলবে। হাসানের বয়স মাত্র দশ বছর। ও কি করে এতো বড় দায়িত্ব পালন করবে? বলাই ওকে অভয় দেয়। তারপর সব বুঝিয়ে দেয়। আগামীকাল থেকে ওদের গতিবিধির ওপর নজর করতে হবে। আর সঠিক খবর এনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে দিতে হবে। সে রাতে হাসানের ঘুম ভাল হলো না। পরদিন সকাল হতেই ছুটে গেল নিজের দায়িত্ব পালনে। এভাবে কয়েকদিন খবর এনে পৌঁছে দিতে লাগল মুক্তি ক্যাম্পে। ওদের গতিবিধি জেনে মুক্তিবাহিনীর কাজগুলো সহজ হয়ে যাচ্ছিল। হাসান ছোট বলে কেউ ওকে সন্দেহ করে না। তবে একদিন এক পাকসেনা ওকে আটকে দেয় পথে। কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর বুদ্ধিমানের মতো দেয় হাসান। তাই ছেড়ে দেয় ওকে। নিজের ওপর গর্ব হয় হাসানের। সেদিন হাসান দেখল পাকবাহিনীর ক্যাম্প কেমন যেন থমথমে। হাসান বুঝতে পারে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। খুব সাবধানে ক্যাম্পের পিছনে লুকিয়ে ওদের কথা শোনে হাসান। সে স্পষ্ট শুনতে পায় আজ রাতে মুক্তি বাহিনীদের ঐ ক্যাম্প ওরা আক্রমণ করবে। যে ক্যাম্পে হাসান খবর দেয়। পড়ি-মরি করে দৌড়ে ক্যাম্পে খবর দেয় হাসান। দলনেতা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারপর সবাই একসঙ্গে পরামর্শ করেন। রাত গড়িয়ে যায়, দূরে একটা কুকুর জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করছে। বাতাসের শন্ শন্ শব্দ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারে পাকবাহিনী চলে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ওদের পরিকল্পনা মতো কাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনী গুলি ছুঁড়তে থাকে। একের পর এক গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীদের কাছ থেকে পাল্টা গুলি আসে না। পাকসেনারা কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। পাকসেনারা গুলি করতে করতে ক্যাম্পের দিকে এগুতে থাকে। অনেকক্ষণ কোন পাল্টা গুলির শব্দ না পেয়ে ওরা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ঠিক তখনই মুক্তিসেনারা গুলি চালাতে শুরু করে। অতর্কিত গুলিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকসেনারা। মুক্তিসেনারা ওদের ঘিরে ফেলে। ২২ জন পাকসেনা নিহত হয় সে রাতে। বাকিরা কোনমতে পালিয়ে যায়। হাসানের সাহসিকতায় বেঁচে গেল মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা খুব খুশি হয়। হাসানের মাথায় হাত রেখে বলে ‘তুমিও বীর মুক্তিযোদ্ধা।’ ছোট হাসানের বুকটা লাল-সবুজের ভালবাসায় ভরে যায়।
×