ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষামাতা রত্নগর্ভা আমিনা খাতুন

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শিক্ষামাতা রত্নগর্ভা আমিনা খাতুন

শিক্ষার মাপকাঠিতে কয়েকটি প্রয়োজনীয় সূচক থাকা আবশ্যক। চার বা পাঁচখানা সনদ থাকলে আমরা তাকে শিক্ষিত বলি। তার মধ্যে শিক্ষাদর্শন থাকুক বা নাই থাকুক। কিংবা সুশিক্ষা আছে কিনা তাও পরখ করা হয় না। একজন মানুষ স্বচেষ্টায় একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ না করেও শিক্ষিত হতে পারে। এমন উদাহরণ জগতে ভূরিভূরি। এমনি একজন মানুষ যিনি সেই ৪০-এর দশকের একজন নারী। সেই সময় একজন নারীর শিক্ষা গ্রহণ বিশেষত মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে অকল্পনীয় বটে। সেই মানুষ ৪০-এর দশকে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এই দশকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নারী শিক্ষার বিদ্যাপীঠে মেট্রিকুলেশন ছিল না। নারীদের দৌড় সেই ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। মেয়েদের পড়াশোনা সেই সময় এই অঞ্চলে এতটুকুই ছিল বলে আর পড়া হয়নি তার। কিন্তু তাতে কী তিনি তাঁর সকল সন্তানকে উচ্চতর পড়াশোনা করিয়েছেন। তারা এখন দেশের মধ্যে অন্যতম অনুকরণীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বড় সন্তান কাজী আখতার হোসেন এইচএসসি বোর্ডস্ট্যান্ড করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন। চাকরির শুরুতে তিনি বোরহান উদ্দিন কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারপর বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রযোজক হিসেবেও ছিলেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (প্রশাসন) করে ইউএনও, এডিসি, ডিসি সবশেষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় সন্তান কাজী আমজাদ হোসেন মুক্তার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। তৃতীয় সন্তান কাজী মনজুর কাদির কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন। চতুর্থ সন্তান কাজী আলী রেজা সহকারী সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন। চতুর্র্থ সন্তান কাজী আতিয়ুর রহমান (জামিল) পাবনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষামাতা রতœগর্ভা মায়ের দুটি কন্যা রাবেয়া কাজী লুসি ¯œাতক পাস করে গৃহকর্মী হিসেবে মনোনিবেশ করেছেন। আর ছোট কন্যা কাজী সাবিহা জামান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেব কর্মরত আছেন। রতœগর্ভা মা আমেনা বেগম ১৯৩৫ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বড়Ñ রিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের সময় দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। প্রায় দুই মাইল হেঁটে বড়ুরিয়া থেকে তিনি কুমারখালী বালিকা বিদ্যালয়ে (১৯৪৭) পড়াশোনা করেছেন। সেই সময় মুসলিম মেয়েদের পড়াশোনা বলতে গেলে ডুমুরের ফুলের মতো ছিল। যদিও এই মা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নাই কিন্তু তিনি সংসার জীবনে প্রাজ্ঞ বহু ভাষাবিদ মাওলানা আব্দুস সাত্তার মিঞার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকে তাঁর মধ্যে শিক্ষার মর্মবাণী আরও বেশি শাণিত হয়। তাঁর স্বামী ঐতিহ্যবাহী কুমারখালী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন। অনেকে তাঁকে প-িত শিক্ষকও বলতেন। সব সন্তানদের উচ্চতর পড়াশোনা করাতে পেরেছেন এবং সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। ৮৩ বছরের এই মহতি শিক্ষামাতা এখনও বটিতে মাছ কাটতে পারেন, কথা বলেন সুন্দর করে। গল্প করেন ’৪৭-এর দেশ ভাগ নিয়েও। এখনও স্মৃতিতে ’৭১ স্মরণ করেন শুনে যেন মনে হয় অবিকল দৃশ্যপট দেখতে পাওয়া গেল। আচরণে খুবই সাদাসিধে স্বভাবের এই নারী প্রকৃতপক্ষে একজন মহতি মানুষ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বও বটে।
×