
ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ শতকে তৈমুর লঙ যখন ইরান দখল করেন, তখন তিনি তখত বা সম্পদের চেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছেন এক কবির প্রতিভাকে। মহাকবি হাফিজের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও কবিতা এখনও ইরানের প্রাণ, মানুষের অন্তরের ভাষা।
কিন্তু ২০২৫ সালে সেই ইরানেই ইসরায়েলের বোমার আঘাতে ঝরে গেল এক তরুণ কবির জীবন। তার নাম পারনিয়া আব্বাসি। বয়স মাত্র ২৩। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, স্বপ্ন দেখা এক মেয়ে।
পারনিয়া লিখতেন কবিতা, ভালোবাসতেন গান শুনতে, নতুন খাবার চেখে দেখতে এবং স্বপ্ন দেখতেন বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর। তিনি শিখছিলেন ইতালিয়ান ভাষা, আর চেয়েছিলেন একদিন কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের কনসার্টে হাজির হতে।
ইরানের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ডামাভান্দ জয় করেছিলেন তিনি। সেটাকে জীবনের এক বড় অর্জন হিসেবে দেখতেন। কারও সঙ্গে আলাপ হলে প্রথমেই বলতেন, "আমি ডামাভান্দে উঠেছি!"
তার বন্ধুরা বলেন, পারনিয়া শুধু কবি ছিলেন না— তিনি ছিলেন বন্ধুদের শক্তি। কেউ মন খারাপ করলে পাশে দাঁড়াতেন, ছোট উপহার দিয়ে খুশি করতেন, আর সবসময় হাসাতেন। হঠাৎ করে এক পা দু’পা করে নাচ শুরু করতেন, হাসির ঝড় তুলতেন চারপাশে।
কিন্তু গত শুক্রবার ভোরে তেহরানের সাত্তারখান এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন পারনিয়া। ইসরায়েলি ড্রোন হামলা সেই বাড়িকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। বেঁচে ফিরেননি কেউই।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা শহিদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরমাণু বিশেষজ্ঞকে লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু পারনিয়ার মতো সাধারণ মানুষ কেন মরলেন?
হামলার পর কেউ কেউ সন্দেহ করে বলেন, পারনিয়া হয়তো নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির আত্মীয়। আবার কেউ মিথ্যা রটায়, তিনি কাসেম সোলাইমানিকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু তার বন্ধুরা ও ফ্যাক্টচেকিং সাইট ‘ফ্যাক্টনামেহ’ স্পষ্ট করে জানায়— এসব কথা মিথ্যা।
পারনিয়া ছিলেন এক সাধারণ কবি। যুদ্ধ-রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি শুধু জীবনকে ভালোবাসতেন, মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাইতেন।
তার ২৪তম জন্মদিন ছিল মাত্র কয়েকদিন পর। হয়তো বন্ধুদের নিয়ে গান-বাজনা আর কবিতায় ভরা একটি ছোট আয়োজন করতেন। কিন্তু সেই আনন্দের জায়গায় এসেছে কান্না, ধ্বংস আর শূন্যতা।
তৈমুর লঙ এক কবিকে রক্ষা করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিলেন একজন সংস্কৃতিপ্রেমী বিজয়ী হিসেবে। নেতানিয়াহু ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন— এক তরুণ কবির প্রাণ কেড়ে নিয়ে ইতিহাসে নিজের নাম লেখালেন ধ্বংসের প্রতীক হিসেবেই।
পারনিয়া আজ নেই। কিন্তু তার লেখা, তার স্মৃতি, আর তার মতো স্বপ্ন দেখাদের গল্প থেকে যাবে আমাদের মনে। তার নিঃশব্দ মৃত্যু আরও একবার মনে করিয়ে দেয়— যুদ্ধ কখনোই কবিতার জবাব হতে পারে না।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট
এম.কে.