তেল। ছবি: সংগৃহীত
ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যের যথেষ্ট ঝুঁকি আছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নানা নিষেধাজ্ঞা যেখানে, কিন্তু তারপরও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন কেন ইরান থেকে তেল কিনে? কারণটা খুবই সহজ, ইরানের তেল মানে ভাল আর দামে সস্তা।
নানা আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের কারণে বিশ্বে তেলের দাম বেড়েই চলছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরান তাদের তেল বিক্রিতে মরিয়া, তারা অন্যদের চেয়ে কম দাম অফার করে থাকে।
ট্রেডার্স আর শিপট্র্যাকার্সের ডেটা নিয়ে রয়টার্স ২০২৩ সালের অক্টোবরে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে বলা হয় ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে চীন অন্তত ১০ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাঁচিয়েছে ইরান, রাশিয়া আর ভেনেজুয়েলা থেকে তেল কিনে, এসব তেলই কমদামে বিক্রি করা হয়।
অপরিশোধিত তেলের যে বৈশ্বিক মানদণ্ড তা পরিবর্তিত হয়, তবে সাধারণ প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের নিচে থাকে।
ডেটা ও অ্যানালেটিক্স ফার্ম কেপিএলআরের সিনিয়র অ্যানালিস্ট হুমায়ুন ফালাকশাহী ধারণা দেন, ইরান তাদের ক্রুড তেল ব্যারেল প্রতি ৫ ডলার কমে বিক্রি করছে। গত বছর ব্যারেলপ্রতি যেটার দাম সর্বোচ্চ ১৩ ইউএস ডলার পর্যন্ত কমিয়ে দেয়া হয়েছিল।
‘চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরাট খেলাটা চলছে ইরান সেটার একটা অংশ,’
ইরানের অর্থনীতিকে সহায়তার মাধ্যমে, চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে একটা ভূরাজনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে যখন ইসরায়েলের সাথে উত্তেজনা চলমান।
‘চায়ের পাত্রে পরিশোধন’
বিশ্লেষকদের বিশ্বাস, ইরান ও চীন কয়েক বছর ধরে একটা সূক্ষ্ণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তেহরানের নিষিদ্ধ তেল আমদানি-রপ্তানির জন্য।
‘এই বাণিজ্য কৌশলের প্রধান উপকরণ হলো- চাইনিজ চায়ের পাত্র (ছোট স্বাধীন রিফাইনারিজ), ‘ডার্ক ফ্লিট’ ট্যাংকার্স ও চীনের আঞ্চলিক ব্যাংক যাদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি খুব কম, বিবিসিকে বলেন, আটলান্টিক কাউন্সিলে ইকোনমিক স্টেটক্র্যাফটের সহকারী পরিচালক মাইয়া নিকোলাদজ।
এসব টিপট যাতে ইরানের তেল পরিশোধন করা হয়, আকারে খুবই ছোট ও আংশিকভাবে স্বনিয়ন্ত্রিত, এগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশাল সব পরিশোধনাগারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এটা আসলে এই ইন্ডাস্ট্রির দেয়া টার্ম, ফালাকশাহী ব্যাখ্যা করেন, যেহেতু রিফাইনারিগুলো দেখতে চায়ের কাপের মতো, খুবই সাধারণ কিছু সুবিধা থাকে এতে, আর বেশিরভাগই মেলে দক্ষিণ-পূর্ব বেইজিংয়ের শানডং অঞ্চলে।
এই ছোট রিফাইনারিগুলোতে চীনের জন্য কম ঝুঁকি থাকে, কারণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং এতে ইউএস ফিনান্সিয়াল সিস্টেমের প্রবেশাধিকার থাকে।
ছোট প্রাইভেট রিফাইনারিগুলো দেশের বাইরে চালিত হয় না, ডলারেও লেনদেন করে না এবং বিদেশি ফান্ডিংয়ের দরকার পড়ে না,” মি. ফালাকশাহী জানান।
‘ডার্ক ফ্লিট’
তেলের ট্যাংকারগুলো বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে ট্র্যাক করা হয়, বিভিন্ন সফটওয়্যার তাদের অবস্থান, গতি ও রুট পর্যবেক্ষণ করে।
এই ট্র্যাকিং এড়ানোর জন্য ইরান ও চীন একটা অস্পষ্ট মালিকানা ধরণের ট্যাংকার্স নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যেটা সঠিক অবস্থান দেখায় না,বলেন নিকোলাদজ।
‘তারা খুব সহজেই পশ্চিমা ট্যাংকার্স, নানান শিপিং সার্ভিস সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পারে। ফলে তাদের পশ্চিমা নীতি, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয় না।’
এসব ডার্ক ফ্লিট তেল বহনের সময় সাধারণত তাদের অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) বন্ধ করে রাখে যাতে তাদের শনাক্ত করা না যায়, অথবা এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গার অবস্থান দেখিয়ে ধোঁকা দেয়।
ধারণা করা হয় এসব জলযান আন্তর্জাতিক জলসীমায় গিয়ে, কোন প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সফার জোনের বাইরে গিয়ে চীনের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য পার করে, এবং কখনো কখনো এজন্য তারা বেছে নেয় খারাপ আবহাওয়ার সময়কে, ফলে এই তেলটি আসলে কোথা থেকে এসেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন হয়ে যায়।
‘মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের পূর্বদিকে একটা অঞ্চল আছে, সেখানে একটা জায়গায় ঐতিহাসিকভাবেই অনেক ট্যাংকার চলাচল করে এবং নিজেদের মধ্যে কার্গো পরিবহন করে। এরপর আসে এই তেলকে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করা।
এই পদ্ধতিটা ব্যাখ্যা করেন মি. ফালাকশাহী, ‘দ্বিতীয় আরেকটা জাহাজ মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমা থেকে আসে চীনের উত্তর-পূর্বে এবং তেলটা তারা পৌঁছে দেয়। এর মাধ্যমে মনে হয় যে এই ক্রুড অয়েল ইরান থেকে আসেনি, বরং মনে হয় মালয়েশিয়া থেকে এসেছে।’
ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) পরিসখ্যান অনুযায়ী, চীন ২০২৩ সালে ২০২২ সালের তুলনায় ৫৪% বেশি তেল মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করেছে।
গত বছরের জুলাই এবং অক্টোবরে রিপোর্ট আসে, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ ইরানিয়ান ট্যাংকার আটক করেছে ‘অনুমতিবিহীন তেল পরিবহনের’ জন্য।
সূত্র: বিবিসি।
এসআর