ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় রকস্টার!

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৭ জুলাই ২০১৭

বিদায় রকস্টার!

নব্বইয়ের দশকের যাদের ইংরেজী গান শোনার হাতেখড়ি হয়েছিল ওহ ঞযব ঊহফ নামের একটা গান দিয়ে। একটি ভিডিও যেখানে একটা অনেক লম্বা মূর্তির ওপর একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কলার বোতাম লাগানো একজন গান গাচ্ছে, আরেকজন র‌্যাপ দিচ্ছে। চেস্টার চার্লস বেনিংটনকে সেখান থেকেই রক ভক্তরা একনামে চেস্টার বেনিংটন নামে চিনেন। বিখ্যাত রক ব্যান্ড লিনকিন পার্কের গায়ক চেস্টার বেনিংটন গত সপ্তাহে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান। এ যেন রক মিউজিকের জগতে ইন্দ্রপতন। নিজের বাড়ি থেকেই লিঙ্কিন পার্কের লিড ভোকালিস্ট চেস্টার বেনিংটনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা নাগাদ লস অ্যাঞ্জেলসের পালোস ভার্দোস স্টেটে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার হয় দেহ। তিনি বহুল পরিচিত লিংকিন পার্কের সহযোগী গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া দুটি রক ব্যান্ড ডেড বাই সানরাইজ ও স্টোন টেম্পল পাইলটসের কারণেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যারিজোনাতে চেস্টার বেনিংটনের জন্ম। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, মা একজন নার্স। মাত্র ৭ বছর বয়সে মানুষের বিকৃত রূপটা ধরা পড়ে চেস্টারের সামনে। বয়সে বড় এক বন্ধুর দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন তিনি। লজ্জায় কারও কাছে এই ঘটনা বলতে পারেননি চেস্টার, কয়েক বছর ধরে সবার অগোচরে চলতে থাকে এই নিপীড়ন। এক সময় চেস্টারের বাবা জেনে যান এই বীভৎস অপরাধের কথা। কিন্তু চেস্টার কোন আইনী ব্যবস্থা নিতে চাননি। কারণ ইতোমধ্যেই তিনি জেনে ফেলেছিলেন, যে ছেলেটি তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছিল, সে নিজেও এমনই এক অপরাধের শিকার হয়েছিল আগে। ১১ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদে মুষড়ে পড়েন তিনি। নিপীড়নের বিবমিষা আর একাকীত্ব, দুটো যেন একেবারে জেঁকে বসে চেস্টারের জীবনে। মেটাল হ্যামার ম্যাগাজিনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার আত্মবিশ্বাস একদম শূন্যের কোঠায় চলে যায়। নিপীড়নের ঘটনায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, আমি এই ঘটনাটা কাউকে জানাতে চাইনি। আমার ভয় ছিল মানুষ আমাকে সমকামী ভাবতে পারে। এটা আমার জীবনের ভয়ঙ্করতম ঘটনা। ‘শৈশবে মাদকের সংস্পর্শেও আসেন চেস্টার। অভিভাবক আর বন্ধুহীন জীবনে আফিম, মেথ, কোকেন আর এ্যালকোহল হয়ে ওঠে তার নিত্যদিনের সঙ্গী। ১৯৯২ সালে মাদক থেকে দূরে সরে যেতে সমর্থ হন তিনি, যদিও পরবর্তী জীবনে এই প্রাণঘাতী নেশা আবার কাবু করে ফেলে তাকে। এ্যারিজোনা থেকে একসময়ে লস এঞ্জেলেসে চলে আসেন চেস্টার। এখানেই তিনি একটি ব্যান্ডের জন্য অডিশন দেন, পরবর্তীতে যেই ব্যান্ডের নাম হয় ‘লিংকিন পার্ক’। ব্যান্ডের লাইন আপ পূর্ণতা পায় চেস্টারের উপস্থিতিতে। তার অসাধারণ কণ্ঠ ‘লিংকিন পার্ক’কে ঈর্ষণীয় সাফল্য এনে দেয়। চেস্টার বেনিংটন পরিচিতি লাভ করেন ২০০০ সালে লিংকিন পার্কের প্রথম এ্যালবাম হাইব্রিড থিওরি-তে ভোকাল হিসেবে গান গাওয়ার মাধ্যমে, যেটি ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছিল। এ্যালবামটিকে ২০০৫ সালে হিরা উপাধি প্রদান করে আরআইএএ, কেননা এটি ওই দশকের সেরা বিক্রীত এ্যালবাম ছিল, এবং এই এ্যালবামের মতো সামান্য কিছু এ্যালবামই আছে যা সফল হিসেবে এত বিক্রি হয়েছে। লিংকিন পার্কের পরবর্তী স্টুডিও এ্যালবামগুলো হলো মীটিওরা, মিনিটস্মিডনাইট, এ থাউজ্যান্ড সানস্লিভিং থিংস্, এগুলো যথাক্রমে প্রকাশ পেয়েছে ২০০৩, ২০০৭, ২০১০ এবং ২০১২ সালে। বেনিংটন সাইড প্রজেক্ট হিসেবে ২০০৫ সালে তার নিজের ব্যান্ড ডেড বাই সানরাইজ-এর আবির্ভাব ঘটান। এই ব্যান্ডটির আত্মপ্রকাশমূলক এ্যালবাম আউট অব এ্যাশেজ ২০০৯ সালের অক্টোবরের ১৩ তারিখে প্রকাশ পায়। বেনিংটনকে ‘শ্রেষ্ঠ ১০০ হেভি মেটাল ভোকালিস্ট’-এর তালিকায় স্থান দেয় হিট। ২৩ বছর বয়সে চেস্টার যখন বিয়ে করেন, তখনও লিংকিন পার্কের জন্ম হয়নি। ১৯৯৬ সালে সামান্থা অলিট নামের এক তরুণীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের ঘরে আসে একটি পুত্র সন্তান। ২০০৫ সালে এই জুটির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরের বছরই চেস্টার বিয়ে করেন তালিন্দা অ্যান বেন্টলিকে, এই স্ত্রীর সঙ্গে চেস্টারের তিনটি সন্তান রয়েছে। চেস্টারের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা একসঙ্গেই সংসার করছিলেন। ২০ জুলাই ছিল চেস্টার বেনিংটনের প্রয়াত বন্ধু সাউন্ড গার্ডেন ব্যান্ডের গায়ক ক্রিস কর্নেলের জন্মবার্ষিকী। গত ১৭ মে আমেরিকার মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত একটি কনসার্টের পর তিনি আত্মহত্যা করেন। এরপর তাকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একটি খোলা চিঠিতে বেনিংটন লিখেছিলেন, ‘একবুক বেদনা নিয়ে এখনও কাঁদছি। তোমার ও তোমার পরিবারের সঙ্গে কিছু বিশেষ মুহূর্ত ভাগ করতে পেরে আমি ধন্য। বন্ধু, তুমি আমাকে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করেছো যা তুমি কখনও জানবে না। এই পৃথিবীতে তোমাকে ছাড়া ভাবতেই পারি না আমি!’ মৃত্যুকালে চেস্টার বেনিংটনের বয়স হয়েছিল ৪১ বছর। লিনকিন পার্ক ব্যান্ডটির সবশেষ এ্যালবাম ‘ওয়ান মোর লাইট’ প্রকাশিত হয় গত মে মাসে। এরপর তারা বের হন সঙ্গীত সফরে। এর অংশ হিসেবে আমেরিকার ম্যাসাজচুয়েটসের ম্যানসফিল্ডে আগামী ২৭ জুলাই তাদের সঙ্গীত পরিবেশন করার কথা ছিল। কিন্তু বেনিংটন যে এভাবে নিজেকে থমকে দেবেন কে জানত!
×