ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

লাইভ ফ্রম ঢাকা ॥ চেনা আকাশ, অন্য আলো

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১০ নভেম্বর ২০১৬

লাইভ ফ্রম ঢাকা ॥ চেনা আকাশ, অন্য আলো

সংবাদটি চমক জাগানিয়া। গুণী নির্মাতা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী সংবাদটি শুনে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে, ‘আমি কেন এই ছবির খোঁজ জানলামই না? আমরা এক আওয়াজের দুনিয়ায় আছি সেখানে দেখি নীরবে নিভৃতে অনেকে শিকার করে আনতেছে বড় মাছ।’ এই বড় মাছ শিকার করে আনা ছবিটির নাম ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। পরিচালক তরুণ বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। এবারের ২৭তম সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ৫২টি দেশের শতাধিক ছবি থেকে মূল প্রতিযোগিতায় ঠাঁই করে নিয়েছে- ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। উল্লেখ্য, এশিয়ান ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে মূল প্রতিযোগিতায় স্থান পেয়েছে ১০টি ছবি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় খবর। ফারুকীর সঙ্গে আমাদেরও সংবাদটির কোন পূর্বাভাস না পাওয়ার কারণ বোধকরি সাদের প্রচারবিমুখ, অন্তর্মুখী স্বভাব। তবে সাদের ছবি যখন তার হয়ে কথা বলে তখন এইটুকু মেনে নেয়াই যায়! ছবির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে আমরা উপস্থিত হই মূল তিন চরিত্রে রূপদানকারী মোস্তফা মনোয়ার, তানভীর আহমেদ চৌধুরী ও তাসনোভা তামান্নার বর্তমান কর্মস্থল বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের কার্যালয়ে। শুরুটা মোস্তফা মনোয়ারকে দিয়ে। কোন নির্দিষ্ট প্রশ্ন নয় বরং জিজ্ঞাসা ছিল তার অভিনয় জীবন ও লাইভ ফ্রম ঢাকায় তার চরিত্র সম্পর্কে। মনোয়ার খুব সহজ কণ্ঠে বললেন অভিনয়ের প্রতি তার ভালবাসার কথা। তার টেলিভিশনে অভিনয় জীবন শুরু ২০০৪-২০০৫ সাল থেকে। কিন্তু বেছে কাজ করার ফলে কাজ করেছেন খুব অল্প। এর আগেও তিনটি ছবিতে কাজ করেছেন। কিন্তু প্রচারের আলোয় এলেন ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ দিয়ে। সাদের সঙ্গে তার পরিচয়ের সূত্র সহকর্মী তানভীর। তার ভাষায় প্রথম আলোচনার পরই সাদ তাকে জানিয়ে দেন তিনি সাজ্জাদ চরিত্রে অভিনয় করছেন। তারপর ক্রমাগত চিত্রনাট্য বিনিময়। ধারণা শেয়ার করা এবং এভাবেই মোস্তফা মনোয়ার হয়ে ওঠেন লাইভ ফ্রম ঢাকার সাজ্জাদ। মনোয়ার বলেন, ছবিটির মূল চরিত্র সাজ্জাদ এবং অন্য সব চরিত্র আবর্তিত হয়েছে সাজ্জাদকে ঘিরেই। সাজ্জাদ আংশিক শারীরিক প্রতিবন্ধী। এ ছাড়া সে আর দশটা যুবকের মতোই। মোটামুটি সচ্ছল জীবন আরেকটু সচ্ছলতার আশায় সে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। শুরুতে ভালই চলছিল। কিন্তু বাজারে ধস তার জীবনকে করে তোলে জটিল। পাওনাদারের ক্রমাগত তাড়নায় সে পালিয়ে বেড়ায়। একপর্যায়ে তার মরিয়া চেষ্টা দেশ ছাড়ার। সে রাশিয়া যেতে চায়। সাজ্জাদের জীবনে প্রেম আছে এবং তা তার শেষ নির্ভরতার জায়গা। কিন্তু সেখানেও আছে সংশয় আর সন্দেহ। হতে পারে শারীরিক সমস্যা এই সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। সে ডমিনেট করতে চায় প্রেমিকার ওপর। সাজ্জাদের ভাই মাইকেল একজন ড্রাগ এডিক্ট। সে ভাইকে ফিরিয়ে আনতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। এই পর্যায়ে এসে মনোয়ার উন্মোচন করেন তার চরিত্রের অপরপিঠÑ হিপোক্র্যাসি, স্বার্থপরতা, নিরাপত্তাহীনতা। সাজ্জাদ জানে তার এই ভাল করতে চাওয়ার পেছনে যত না ভাতৃপ্রেম তার চেয়ে বেশি আত্মতুষ্টি। তার স্বপ্ন নিজেকে ঘিরে, ভালবাসা নিজের জন্য, চাওয়া নিজের মতো করে। এখানেই সাজ্জাদরূপী মোস্তফা মনোয়ার হয়ে ওঠেন আর দশটা চেনা যুবকের মতোইÑ সাদা কালো। ছবিতে সাজ্জাদের প্রেমিকা চরিত্রটির নাম রেহানা। অভিনয় করেছেন তাসনোভা তামান্না। তার ভাষায় রেহানা এই ঢাকাতে বেড়ে ওঠা এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পড়ালেখা শেষে ব্যাংকে চাকরি করে। তার জীবনে প্রেম আছে। দশটা সাধারণ মেয়ের মতো প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন থাকে। তামান্না যতটা সহজ করে বললেন, বিষয়টি কি আসলেই অতটা সহজ? হ্যাঁ, খুব সাধারণ মেয়ে তামান্না যে, নিজ হাতে আচার বানিয়ে প্রেমিককে নিবেদন করে। অন্য পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বলার অপরাধে প্রেমিকের প্রহার সহ্য করে। আবার এই তামান্নাকে দেখি ক্ষোভে ফেটে পড়ে চিৎকার করতে, ‘আমি কেন তোমার কথা শুনব।’ এই তামান্নাই জ্বলে ওঠেন, যখন তিনি পলায়নরত প্রেমিককে ফেরাতে মরিয়া হয়ে কলার জাপটে ধরে প্রশ্ন করেন ‘কোথায় যাও তুমি’? সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যের অভাব আছে রেহানা চরিত্রে এ কথা বলার পথ নেই। তামান্না আমাদের আরও জানান ২০১৫-এর ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে ছবির শূটিং শুরু হয়ে একটানা ১৭ দিনে ছবিটির চিত্রায়ন শেষ হয়। এরপর সম্পাদনায় সময় লেগেছে প্রায় সাত মাস। তামান্নার কাছে প্রশ্ন ছিল পারিশ্রমিক নিয়ে। তামান্নার সোজা উত্তর, ছবির গল্প আমাদের এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, এ ধরনের কোন আলোচনাতেই আমরা যাইনি। সিলভার স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ডে ছবিটির অবস্থান নিয়ে তামান্না বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি তাতে ছবিটি খুব ভাল অবস্থানেই আছে। সম্ভবত মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র সঙ্গে কান ও ভূষণ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ছবি ‘দি ইয়েলো বার্ডের’। সেই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী তামান্না এও জানানÑ বেস্ট পারফরমেন্স এ্যাওয়ার্ডের দৌড়ে মোস্তফা মনোয়ারের অবস্থান প্রথম। তানভীরের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল, ছবিতে ব্যবহৃত কিছু ভাষা নিয়ে। তানভীর জানালেন সাদা কালো ঢাকাকে ফুটিয়ে তুলতে এবং গল্পের প্রয়োজনে এই ভাষার প্রয়োজন ছিল। তাই ব্যবহার করা। জানতে চাইলাম মাইকেল কি ফিরবে স্বাভাবিক জীবনে? তার হেঁয়ালিভরা উত্তর হয়ত ফিরবে আবার ফিরবেও না অর্থাৎ ফিরে হারিয়ে যাওয়া। যেমন মনোয়ারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গল্পের পরিণতি, তার প্রেম কি সফল হবে? মনোয়ারের হেঁয়ালিভরা উত্তর হয়ত হবে। তবে মুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করুন! তিন প্রধান চরিত্রই সমস্বরে অভিনয়নের ক্ষেত্রে সাদের দেয়া স্বাধীনতার কথা বলেছেন। আমাদের ধারণা এই স্বাধীনতাই সাদের শৃঙ্খল। যে কারণে প্রতিটি চরিত্র রূপ দিয়েছেন সাদের নিসস্ব ভাবনায়। আর সেটাইতো একটি ভাল ছবির শক্তির জায়গা । ছবিটির গল্প ও চিত্রনাট্য সাদের। প্রযোজক শামসুর রহমান আলভী। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খেলনা ছবি। পরিচালক আগামী জানুয়ারিতে ছবিটি হলে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। শুরুটা করেছিলাম ফারুকীর স্ট্যাটাস দিয়ে। সিলভার স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ডের গুরুত্ব বোঝাতে আবার তার কাছে ফিরে যাই। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী আরও লিখেছেন, ‘যারা ফেস্টিভ্যাল দুনিয়ার খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন কোন্ ফেস্টিভ্যালে সিলেকশনের গুরুত্ব কি। সব ফেস্টিভ্যালই এক নয়। দুনিয়ার হাতেগোনা বিশ তিরিশটা ফেস্টিভ্যাল ম্যাটার করে। বাকি তিরিশ চল্লিশটা ‘ওকে’। এ্যান্ড দেয়ার আর থাউজেন্ডস হুইচ ডাজনট ম্যাটার ম্যাচ। কোন কোন ফেস্টিভ্যালের সব এ্যাওয়ার্ড এক জায়গায় করলেও অন্য ফেস্টিভ্যালের নরমাল সিলেকশনের চেয়েও ওজন কম হবে। দিস ইজ এ ট্রুলি ইম্পরট্যান্ট সিলেকশন এ্যান্ড মেকস মি ট্রুলি হ্যাপি এ্যান্ড প্রাউড টু সি দিস ইন দ্য কম্পিটিশন। ব্রাভো। এর নির্মাতাকে যারা চেনেন আমার হয়ে সালাম দেবেন।’ আমাদের কাছে প্রথম চমক ছিল ছবির নাম। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তায় লাইভ! কিন্তু চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে মনে হলো এর আর কোন বিকল্প হতে পারত না। সাজ্জাদ। রেহানা, তানভীররা কোন নির্দিষ্ট চরিত্র নয়। আমাদের চারপাশে সারাক্ষণ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে শত- সাজ্জাদ, রেহানা কিংবা তানভীর। ছবির নামটিই সম্ভবত ছবির মূল বার্তা। আর কেন সাদা কালো? তামান্না বলছেন, সাদের চোখে ঢাকা অনেকটা দিনের পিঠে রাত্রির মতো, ভালবাসার বিপরীতে ঘৃণার মতো আর এই ঢাকাকে তাই সাদ দেখেন সাদা চোখে। এই চলমান ঢাকাকে সাদা চোখে দেখে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ তুলে এনেছেন সাদাকালোতে- লাইভ ফ্রম ঢাকা। খুব চেনা আকাশে এক অন্য আলো।
×