অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিদেশ থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে অবস্থান করে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে গডফাদাররা। তাদের কয়েকজন মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেফতার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বাকিরা আগে থেকেই পলাতক। এ কারণে মাঝে মধ্যে স্বর্ণের চোরাচালানসহ বাহক বা জড়িতরা আটক হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে স্বর্ণ চোরাচালানের অন্তত ১৫টি চ্যানেল রয়েছে। যারা আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন লোক দিয়ে বিদেশ থেকে স্বর্ণ এনে পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। যেখানে এক চ্যানেলের লোক জানে না অন্য চ্যানেলে কে কাজ করে। প্রতিটি চ্যানেলে অন্তত আটটি পর্যায়ের অংশীজন রয়েছে। তারাই চোরাচালানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে ও সুবিধা ভোগ করে।
মূল হোতাদের তালিকায় আছে নজরুল ইসলাম লিটন, মোঃ আলী, রিয়াজ চেয়ারম্যান, জসিম উদ্দিন, আজাদ আহমেদ, মাসুদ কবির, রায়হান আলী, সালেহ আহম্মদ, গৌরাঙ্গসহ (নেপালের নাগরিক) অন্তত ১৫ জন। তাদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে আছে। সেখান থেকেই বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে যাদের গ্রেফতার হয়েছিল নজরুল ইসলাম, মোঃ আলী, রিয়াজ চেয়ারম্যান, জসিম উদ্দিন। পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যায় তারা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দাবি: দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে অধিকাংশ স্বর্ণ আসে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এগুলো পাচার হয় ভারতে।
স্বর্ণ চোরাচালান মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ আসে দুবাই থেকে। কিছু স্বর্ণ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। বাকিটা পাচার হয়ে যায় ভারতে। দুবাই-বাংলাদেশ-ভারত, চোরাচালানের জন্য ব্যবহার হচ্ছে এই রুট। এ কারণে চোরাচালানের সঙ্গে ভারতের কিছু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বাংলাদেশে স্বর্ণের চোরাচালান আসার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের অন্যতম স্বর্ণ ব্যবহারকারী দেশ ভারত। কিন্তু স্বর্ণ আমদানিতে দেশটিতে শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় চোরাচালানে আগ্রহ বেড়েছে তাদের। এই সুযোগে বেশি লাভের আশায় চোরাচালান চক্র গড়ে তুলেছে বাংলাদেশীরা।
চোরাচালানের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে আসে অধিকাংশ স্বর্ণ। এর সঙ্গে জড়িতরা সেখানে বসে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম। একটি অনলাইনকে তিনি বলেন, চোরাচালানের বড় অংশটি আসে দুবাই থেকে। এর মূল হোতারাও পালিয়ে গিয়ে সেখানে বসেই এই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে আটক হলেও জামিনের সুযোগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা তাদের আটকের চেষ্টা করছি।
বিদেশে অবস্থানকারী মূল হোতা, দেশে অবস্থান করা প্রভাবশালী ব্যক্তি, স্বর্ণ ব্যবসায়ী, বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব চোরাচালানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে। তাই সহজেই চোরাচালান আসছে বাংলাদেশে। তবে মাঝে মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হলে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধরা পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৩ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬৭ কেজি স্বর্ণ আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এগুলোর বাজারমূল্য ৭৯১ কোটি টাকা। সবশেষ গত ২৪ অক্টোবর চার কোটি টাকা মূল্যের ৮০টি সোনার বারসহ তিন ব্যক্তিকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (উত্তর) বিভাগ। আটক ব্যক্তিরা হলো ফারুক আহম্মেদ, মীর হোসেন ও মোঃ শাহীন। তাদের মধ্যে মীর হোসেন রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের ক্যাটারিং বিভাগের কর্মচারী। ফারুক নিজেই চোরাচালানে আসা স্বর্ণের কিছু অংশের মালিক আর শাহীন গাড়িচালক। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ফারুক আহম্মেদ স্বর্ণ চোরাচালান করছে তিন বছর ধরে। তারা তিন ভাইÑমাসুদ করিম রানা, ফারুক আহম্মেদ ও রহমত বারী। ফারুককে ধরার পরদিনই তার ভাই মাসুদ করিম রানাকে আটক করতে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, সে দুবাই পালিয়ে গেছে। মাসুদ একসময় দুবাইয়ে থাকত। সেখান থেকেই স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মেলায় সে। দেশে ফিরে এসে দুই ভাইকে নিয়ে নিজেই গড়ে তোলে চোরাচালানের সিন্ডিকেট। তিন বছর ধরে অবৈধভাবে স্বর্ণ আনছে এই সিন্ডিকেট। দুই-তিনটি স্বর্ণের চালানে সপ্তাহে গড়ে ১৫ কেজি স্বর্ণ আনত তারা। এর কিছু অংশ বিক্রি করত দেশীয় বাজারে। বাকিটা পাঠিয়ে দেয়া হতো ভারতে।
চোরাচালানে জড়িত থাকার অপরাধে দুই শতাধিক বাহক ও মূলহোতাকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খানের। তিনি ওই অনলইনকে বলেন, আমাদের অভিযানে বাহক, মূলহোতা উভয়ে গ্রেফতার হয়েছে। তবে বাহকের সংখ্যাই বেশি। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক জড়িতকে আটক করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
মূলহোতারা আটক না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে সিআইডি অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণ চোরাচালান করে থাকে খুব শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে প্রভাবশালীরাও জড়িত। এ কারণে মূলহোতাদের চেয়ে স্বর্ণ বহনকারীরাই আটক হচ্ছে বেশি। স্বর্ণ কার কাছ থেকে এসেছে, কোথায় যাবে বা কার কাছে যাবে, এসব ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানে না বাহকরা। ফলে তাদের আটকের পর কারা চোরাচালানের পেছনে রয়েছে তা শনাক্ত করা বেশ কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই তা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই মূলহোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ বছরের ২ মার্চ ১২৪ কেজি স্বর্ণ চোরাচালান আটক মামলায় ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। চার বছরেরও বেশি সময়ের তদন্তে সবশেষ তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে চার্জশীট দাখিল করেন ডিবির (উত্তর) সিনিয়র সহকারী কমিশনার গোলাম সাকলাইন। তিনি ওই অনলাইনকে বলেন, আমরা দীর্ঘ তদন্ত শেষে চার্জশীট জমা দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হলো জড়িতদের অনেকে জামিনে বেরিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তারা আবারও নতুনভাবে স্বর্ণ চোরাচালান শুরু করেছে। গত জানুয়ারিতে ১০৫ কেজি স্বর্ণ চোরাচালানের মামলার চার্জশীট দাখিল করে পুলিশ। এতে আসামি করা হয় বিমানের পরিদর্শন কর্মকর্তা শাহজাহান সিরাজ, এসএম আবদুল হালিম, এয়ারক্রাফট মেকানিক এ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূঁইয়াসহ ২৫ জনকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বিমানবন্দর জোনাল টিমের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মহররম আলী বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে অনেকে জড়িত। তাদের সবাইকে আটকের চেষ্টা চলছে।
চোরাচালানে আসা স্বর্ণের একটি অংশ বাংলাদেশের জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা কিনে থাকে। অথচ এই পদ্ধতি অবৈধ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলারি মালিক সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়াল ওই অনলাইনকে বলেন, দেশে অনেক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে। কেউ কিন্তু এখনও প্রমাণ করতে পারেনি যে বাংলাদেশের কোন জুয়েলার্স এসব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। রিসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে আমরা যা পাচ্ছি তাতে চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ফলে চোরাচালান করে স্বর্ণ আনার প্রয়োজন হয় না। স্বর্ণ নীতিমালা না থাকার কারণে ব্যবসায়ীদের এ ধরনের অপবাদ দেয়া হচ্ছে বলে মনে করেন বাজুস সাধারণ সম্পাদক। তার ভাষ্য, নীতিমালার কাজ চলছে খুব দ্রুতগতিতে। এটি হয়ে গেলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জুয়েলার্স ব্যবসাকে জড়ানোর সুযোগ থাকবে না। ফলে তখন আর আমাদেরও প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে না।