ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মৎস্য শিকার বিচিত্র উৎসব

-

প্রকাশিত: ২২:০৪, ৬ অক্টোবর ২০২২

মৎস্য শিকার বিচিত্র উৎসব

ময়মনসিংহের নান্দাইলের বিলে মাছ ধরার উৎসব

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাচীন জেলা ময়মনসিংহে হারিয়ে যেতে বসেছে উৎসবের মাছ ধরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদী নালা খালে বিলে যেমন পানির প্রবাহ কমেছে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক জলাশয়ে কমে গেছে মাছের প্রজননও। ফলে চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন কমার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মাছ ধরাও। ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্রসহ স্থানীয় নদ নদী ও খাল বিলসহ প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে মাছের খরা চলছে।

জেলে কিংবা সৌখিন শিকারি কারও জালে এখন আর তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। বর্ষাকালেও মাছের আকাল দেখা দিচ্ছে। শীতকালেও একই অবস্থা। পানির তেমন প্রবাহ না থাকায় পুরনো ব্রহ্মপুত্রেও জেলের কিংবা  শৌখিন শিকারিদের মাছ ধরা চোখে পড়ে না। অথচ ‘হাওর বাওর মহিশের শিং-এই তিন এ ময়মনসিংহ’ প্রচলিত প্রবাদটির সঙ্গে ময়মনসিংহে উৎসবের মাছ ধরার এক সময় যথার্থ মিল খুঁেজ পাওয়া যেত। এক সময় ময়মনসিংহের হাওর নদী ও খালে বিলে প্রচুর সুস্বাদু মাছ ধরা পড়ত।

প্রতি বছরের নির্ধারিত একটি দিনে ময়মনসিংহের চিহ্নিত কয়েকটি হাওর বিল ও ডোবায় ঘটা করে আনন্দ উৎসবের সাথে ছেলে বুড়োরা মেতে উঠতেন সেই মাছ ধরার প্রতিযোগিতায়। স্থানীয়ভাবে হাইত, হাওক ও বা-হইত নামে পরিচিত উৎসবের এই মাছ ধরা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। সাধারণত শীতের শেষ থেকে শুরু করে চৈত্র-বৈশাখ পর্যন্ত ছিল এই মাছ ধরা। পলো, চাবি জাল, উড়া জাল, শিব জালসহ নানা জাতের সামগ্রী নিয়ে মাছ ধরার ঐতিহ্যে মেতে উঠতেন ময়মনসিংহের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। মাছ ধরার এই উৎসব ছিল ময়মনসিংহের গ্রামীণ সংস্কৃতিরও একটি অংশ।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছিল কয়েকটি বিল, ডোবা ও খাল। এর মধ্যে ময়মনসিংহ সদরের নাওভাঙ্গা ও পুটামারা বিল, লাখের ডোবা, নান্দাইল উপজেলায় বলদার বিল, টঙ্গীর বিল, জাইল্ল্যার বিল, জলুন্দার বিল, জলহরি বিল, সাবার বিল, বাহাইল বিল, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার শিরনী বিল, ডেইলা ও আন্দাইল বিল, গৌরীপুরের জলবুরুঙ্গা, ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়বিলার বিল, ত্রিশাল উপজেলায় বাইক্কার বিলসহ অনেক বিল ও ডোবা অবশ্য এখনও রয়েছে।

শীতের শুরুতে এসব বিল ডোবা ও খালের পানি কমতে থাকে ক্রমশ। আর তখনই শুরু হত এই মাছ ধরার উৎসব। অনেক এলাকায় আগাম ঘোষণা দিয়ে বছরের একটি নির্ধারিত দিনে এই মাছ ধরার উৎসব  হতো। এ জন্য স্থানীয় হাট ও বাজারে ঢাক ঢোল পিটিয়েও আগাম এই ঘোষণা দেয়ার রেওয়াজ ছিল। মাছ ধরার এমন উৎসবে ছেলে বুড়ো সবাই যোগ দিত।

তবে এ জন্য কাউকে কোন ফী দিতে  হতো না। সবার জন্যই এই মাছ ধরা ছিল উন্মুক্ত। আনন্দ উৎসবের আমেজে মাছ ধরা শেষে সকলেই বাশ কিংবা খুটিতে মাছ ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতেন আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে। আশির দশক থেকে বিগত দুই হাজার সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহে উৎসবের এই মাছ ধরা ছিল চোখে পড়ার মতো।
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন পানি শুন্যসহ দখল জবরদখল ও পলি জমে ভরাট হওয়ায় এসব বিল ডোবা ও খালের অস্তিত্ব এখন বিপন্নের পথে। আর যে সব বিল ও ডোবায় পানি থাকছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল সেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করায় উৎসবের মাছ ধরার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। ময়মনসিংহ সদরের নাওভাঙ্গা বিল ছিল ভূমিহীনদের নামে বরাদ্দ।

প্রভাবশালী মহল পরে এই বরাদ্দ কিনে নিয়ে এখন মাছ চাষ করছেন বাণিজ্যিকভাবে। এ রকম অনেক বিলই এখন প্রভাবশালীদের কব্জায়। এ ছাড়া সেচ দিয়ে মাছ ধরার কারণে মাছের বংশ বৃদ্ধিও বাধগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি মাছ ধরার পলো ও জালসহ নানা উপকরণও এখন ব্যয়বহুল ও দুর্লভ হয়ে পড়ছে। এসব নানা কারণে ময়মনসিংহ অঞ্চলের এক সময়কার ঐতিহ্যের এই মাছ ধরার উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। তার পরও মাঘী পূর্ণিমাসহ বিশেষ দিনক্ষণে নান্দাইল উপজেলার বিলে এখনো কদাচিৎ চোখে পড়ে মাছ ধরার রঙিন উৎসব।
বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ

×