ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাবু বাজার ও যাত্রাবাড়ীতে অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন হচ্ছে আজ

পদ্মা সেতুর যানবাহনের চাপ সামলাতে প্রস্তুত রাজধানী

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৬ জুন ২০২২

পদ্মা সেতুর যানবাহনের চাপ সামলাতে প্রস্তুত রাজধানী

শংকর কুমার দে ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পর দক্ষিণ জনপদের দুয়ার খুলে গেছে। কিন্তু দক্ষিণের যানবাহনের চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সেতুর উত্তর জনপদ রাজধানী ঢাকা এখন প্রস্তুত। রাজধানী ঢাকার বাবুবাজার ও যাত্রাবাড়ী পয়েন্টে রবিবার থেকে মোতায়েন হচ্ছে অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ। প্রতিদিন পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে প্রায় ২১ হাজার ৩শ’ যানবাহন। যানবাহনের চলাচলে টোল আদায়ের হিসাব অনুযায়ী পদ্মা সেতুর নির্মাণে যে ব্যয় হয়েছে তার খরচ উঠে আসতে সময় নিতে পারে প্রায় ১৭ বছর। পদ্মা সেতু শনিবার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু উদ্বোধন করার পর যে নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে তাতে নতুন দিনের নানা হিসাব নিকাশ চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর সড়কপথে আরও সহজ হয়ে গেছে দেশের দক্ষিণ জনপদে পৌঁছানোর দুয়ার। তাতে রাজধানী ঢাকার ওপর দিয়ে উভয়মুখী যানবাহনের চাপ বাড়বে। সেই চাপ কতটা নিতে পারবে ঢাকা? এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে। আলোচনায় বলা হয়েছে, যেসব যাত্রী বা পণ্যবাহী গাড়ি শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে দক্ষিণের বিভিন্ন গন্তব্যে যায়, সেসব যানবাহন সেতু দিয়ে পদ্মা পার হবে। তাতে কমে আসবে যাত্রার সময়। পদ্মা সেতু চালু হলে পণ্যবাহী যানবাহনের একটা অংশ হবে ভারতের। দেশটির পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে পণ্য পরিবহন হবে এই পথে। সমীক্ষা অনুযায়ী, শুরুর দিকে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে, পরে তা আরও বাড়বে। উত্তরবঙ্গ বা ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে সরাসরি সড়ক পথে দক্ষিণবঙ্গে যেতে হলে ঢাকার ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুতে উঠতে হবে। আবার ফিরতি পথেও সেসব গাড়িকে রাজধানী পার হতে হবে। চট্টগ্রাম বা সিলেটগামী যানবাহনও ঢাকার যাত্রাবাড়ী হয়েই যায়। ঢাকাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ না থাকায় পুরো চাপ পড়বে রাজধানীর ওপর, যদিও ঢাকায় তাদের হয়তো থামার প্রয়োজনই হতো না। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদিন পদ্মা পার হতে হতো ফেরিতে। তাতে কিছু সময়ক্ষেপণ হতো। ফলে এক সঙ্গে অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশের সুযোগ ছিল না। কিন্তু সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের গাড়ি দ্রুতই ঢাকা চলে আসবে। পদ্মা সেতু থেকে নেমে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ঢাকার সড়কগুলোকেই। একইভাবে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকার ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুর দিকে যাবে গাড়ি। তাতে ঢাকার প্রবেশ পথ, বিশেষ করে বাবু বাজার ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জগামী রাস্তা, পোস্তগোলা থেকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার রাস্তায় যানজট বাড়বে। কিন্তু নিত্যদিনের যানজট সামলাতেই যেখানে ঢাকা হিমশিম খাচ্ছে, রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে যেখানে প্রায়ই জট লেগে থাকছে, বাড়তি গাড়ি সেখানে কীভাবে সেতুতে পৌঁছবে? ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যানবাহন চলাচলে চাপ কমাতে ‘সামর্থ্য অনুযায়ী’ বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেটা রবিবার থেকেই দৃশ্যমান হবে। এখন ঢাকায় অতিরিক্ত যানজট তৈরি হওয়ার আশঙ্কার কারণ রিং রোড নেই, ডাইভারশন রোড নেই, বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি। ঢাকার যানজট সামলাতে ব্যর্থ হলে পদ্মা সেতুর সুফল অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হতে পারে মনে করেই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সেতু দিয়ে পারাপার হওয়া বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায়ের মাধ্যমে সরাসরি খরচ উঠিয়ে আনাই হচ্ছে অন্যতম উপায়। এই সেতু দিয়ে দেশের ২৩ জেলায় প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে, যা ২০২৫ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৬০০। এদের সবার থেকে টোল বাবদ যে আয় হবে, শুধু তা দিয়ে সেতুর ব্যয় উঠে আসতে সময় লাগবে সাড়ে ৯ বছর। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সেতু পারাপারে টোল হার কার্যকরের মাধ্যমে সরাসরি ব্যয় তুলে আনার বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) একটি নিজস্ব গণনা পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতিকে যে এলাকায় সেতু নির্মিত হবে, ওই এলাকায় ফেরি পারাপার থেকে দৈনিক যে পরিমাণ টোল আদায় করা হয়, সেতু পারাপারে তার দেড় থেকে দুই গুণ টোল ধার্য করার নিয়ম রয়েছে। পদ্মা সেতুতেও টোল হার নির্ধারণ করার আগে ফেরিতে কি পরিমাণ টোল আদায় হয় এবং কি পরিমাণ যানবাহন পারাপার হয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই সংস্থার তথ্য মতে, ২০২০ সালের নবেম্বরে মাওয়া এবং জাজিরার মধ্যে ফেরিতে যানবাহন পারাপারে দৈনিক ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় হয়েছে। সেতু বিভাগ (বিবিএ) এ পরিসংখ্যানকে ভিত্তি ধরে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা টোল আদায়ের আশা করছে। অর্থাৎ বিআইডব্লিউটিএর আয়ের দেড়গুণের বেশি এবং দুইগুণের কম আয়ের একটি মধ্যবর্তী ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে ১ শতাংশ হারে সুদে সরকারকে ফেরত দিতে হবে। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে বলা হয়েছে, ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে টাকাটা (নির্মাণ ব্যয়) উঠে আসবে। এখন মনে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই টাকাটা উঠে আসবে, কারণ মোংলা পোর্ট যে এত শক্তিশালী হবে, পায়রা বন্দর হবে, এত শিল্পায়ন হলে যা ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আসেনি। পদ্মা সেতুর কারণে অর্থনীতিতে গতি আসবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত। শুধু এই প্রাপ্তি হিসাবে নিলেই মাত্র ৯ মাসে পদ্মা সেতুতে ব্যয়ের সমপরিমাণ অর্থ যোগ হবে অর্থনীতিতে। তা ছাড়া সেতুতে প্রতিদিন যে টোল আদায় হবে, শুধু সেটা হিসাব করলে সাড়ে ৯ বছরে সরাসরি উঠে আসবে সেতুর নির্মাণব্যয়। সেতু বিভাগের প্রাথমিক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৫ বছরে উঠে আসবে পদ্মা সেতুর ব্যয়। একই ইস্যুতে দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বলছেন, সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ বছর এবং কেউ আবার ১৭ বছরের কথা বলছেন। তবে যানবাহন চলাচলের চাপ ও টোল আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে আরও কম সময়ের মধ্যেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় উঠে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
×