ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা মেঘনা যমুনা- এক সুতায় বাঁধা সড়ক যোগাযোগ

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২৩ জুন ২০২২

পদ্মা মেঘনা যমুনা- এক সুতায় বাঁধা সড়ক যোগাযোগ

সমুদ্র হক ॥ সেতু বন্ধন পদ্মা পাড়ের সুর মিলিয়ে দিয়েছে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের সেই স্লোগান ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’ আজ স্বপ্ন নয় বাস্তব। সেই বাস্তবতার ওপর ভর করে সারাদেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতোয় বেঁধেছে পদ্মা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাংলার গর্বের দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ ভূখ-কে তিনটি অঞ্চলে সম্পৃক্ত করেছে তিনটি নদী পদ্মা মেঘনা যমুনা। রাজধানী বৃহত্তর ঢাকা ঘিরে মধ্যাঞ্চল। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ ঘিরে পূর্বাঞ্চল। পশ্চিমাঞ্চল পরিচিতি পেয়েছে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল বিভাগকে নিয়ে। অতীতে গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে দেশে ১৭ জেলা থাকাকালীন সবচেয়ে বড় বিভাগ ছিল রাজশাহী। এই বিভাগের মধ্যে ছিল খুলনা ও বরিশাল অঞ্চল। তখনই নামকরণ হয় পশ্চিমাঞ্চল। স্বাধীনতার পর সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত করেছে মেঘনা, মেঘনা-গোমতী, ভৈরব ও বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর মধ্যাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বাকি ছিল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দুই বিভাগ খুলনা ও বরিশাল। পদ্মা সেতু সারাদেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতোয় বেঁধে দিল। সার্থক হলো ইতিহাসের সেই স্লোগান- তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। এই আনন্দধারায় ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পশ্চিমাঞ্চলের (তথা দক্ষিণাঞ্চল) মানুয়ের ঈদ যাত্রা আরও মধুময় করে তুলবে। ওই সময়ে ধূসর রঙের ৪১টি স্প্যানের ওপর ভরা চাঁদের পূর্ণিমার আলোয় ফুটে উঠবে এক নিসর্গ। সেতুর ৪১৫টি বাতির ঝলকানি পদ্মার ঢেউয়ে মায়াবি নাচনে ভরে তুলবে। একটি সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুতে বিশেষ ধরনের ‘আর্কিটেকচারাল লাইটিংয়ে’ আলোকসজ্জার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অত্যাধুনিক এমন লাইটিং এই দেশে প্রথম। প্রথমে কথা ছিল সেতু উদ্বোধনের দিনেই এই লাইটিং প্রজ্বালিত হবে। পরে বলা হয় অন্যতম এই লাইটিং বসাতে কিছুটা সময় নেবে। আশা করা হয়েছে সেতু উদ্বোধনের পর বসানো হবে। জাতীয় দিবসগুলো এবং বিভিন্ন উৎসবে সেতুর ওপর আলোর প্রক্ষেপণে নিসর্গের ভুবন তৈরি করে এই আর্কিটেকচারাল লাইটিং। জানা যায়, এই ধরনের লাইটিং দুবাইয়ে বুর্জ খলিফায় আছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে প্রথম আতশবাজি ফুটিয়েছে নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। সেদিন ছিল ২০১৫ সালের ১ মার্চ। নদী শাসনের পর পাইলিং কাজ শুরুর আগে তারা পদ্মার ঢেউকে রাঙিয়ে তোলে আতশবাজি ঝলকানিতে। উল্লেখ্য আতশবাজি চীন দেশের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। তারা যে দেশেই যায় দুই দেশের মিলন বন্ধনের শুভ মুহূর্তকে বরণ করে আতশবাজিতে। পাইলিং দিয়ে যাত্রা শুরু করে পিলার নির্মাণের পর সর্বশেষ দুই প্রান্ত মাওয়া ও জাজিরাকে সংযুক্ত করেছে ইস্পাত নির্মিত ৪১টি স্প্যান। শেষ স্প্যানটি বসেছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তে ১২-১৩ পিলারের ওপর। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। দুই প্রান্তের এ্যাপ্রোচ রোডের (১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার) দুই ধারে সবুজ বনায়নে ছেয়ে দেয়া হয়েছে। যা সবুজে আরেক নিসর্গ তৈরি করেছে। সড়ক বিভাজনে নানা জাতের ফুল ফুটে এখনই সুগন্ধ ছড়িয়েছে। এই সময়ে ভরা বর্ষায় পদ্মায় পানি প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে সাড়ে ৪ মিটার। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে ভাটির দিকে পদ্মা এখনও চিরযৌবনা। তীব্র ¯্রােতধারার ঢেউ এখনও উথাল-পাতাল করে দেয়। সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগের অবস্থানে পদ্মার এত ঢেউ। খর¯্রােতা। পদ্মা সেতু যেখানে নির্মিত হচ্ছে বর্ষায় নদীর গভীরতা প্রায় ৬০ মিটার। সেতুর এক প্রান্তে দোগাছি সার্ভিস এরিয়ায় স্থাপিত হয়েছে জাদুঘর ও প্রজাপতি পার্ক। কি নেই এই জাদুঘরে। জীববৈচিত্র্যের এত বড় সংযোজন দেশে এই প্রথম। বর্তমানে ২৩৫২ প্রজাতির প্রাণীর নমুনা সংযোজিত হয়েছে। বলা হয়েছে এই জাদুঘর হবে প্রাণিবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা কেন্দ্র। এটি বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য জাদুঘর উন্মুক্ত থাকবে। জাদুঘরের সঙ্গেই থাকছে প্রজাপতি পার্ক। এই পার্ক ইকো ট্যুরিজমে বড় ভূমিকা রাখবে। পদ্মা অববাহিকার জেলা মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ অঞ্চলের প্রাণীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হবে। এদিকে জুলাই মাসে সেতুতে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে রেল মন্ত্রণালয় রেললাইন স্থাপনের কার্যক্রম বুঝিয়ে নিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে। যেভাবে পারাপার ছিল পদ্মা ॥ পদ্মা পারাপারে ফেরি সার্ভিসের প্রধান অংশ বিদায় নিল। কেমন ছিল সেই দিনÑ মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ফেরিঘাটে ফেরি নোঙ্গর করার পর যানবাহন উঠত ফেরিতে। এরপর রওনা দিয়ে ওপারে পৌঁছাতে সময় নিত প্রায় দুই ঘণ্টা। তারপর দক্ষিণাঞ্চলের পথে রওনা। (যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে যেভাবে আরিচা-নগরবাড়ি ফেরি সার্ভিস ছিল তেমনই ছিল দক্ষিণাঞ্চলগামী ফেরি সার্ভিস)। মাওয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের প্রাণচাঞ্চল্য আর রইল না। নতুন যুগের সূচনা করে দিল পদ্মা সেতু। ফেরি পারাপারের দুর্ভোগ নেই। দুই ঘণ্টা সময়ের পরিবর্তে এলো মাত্র চার থেকে ছয় মিনিট সময়। কুয়াশায় ফেরি পারাপারে সময়ক্ষেপণ থাকল না। ফেরি ঘাটের হোটেলগুলোর তাজা মাছের তরকারি অতীতের খাতায় রয়ে গেল। খালাসির হাঁকডাক চেঁচামেচি এখন নীরব নিথর। তবে একটি সূত্র বলেছে, মানিকগঞ্জের পাটুয়ারি থেকে দৌলতদিয়া ফেরি সার্ভিস এই মুহূর্তে বন্ধ হবে না। আরও কিছুদিন সচল থাকবে। রিক্যাপ- দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার পদ্মা ॥ ২০১২ সালে দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের পর শুরু হয় নির্মাণ যজ্ঞ। এক দশক পর এ বছর ২৫ জুন চালু হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এরপর ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বিশ^ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানানো হয় তোমাদের কাছে থেকে ঋণ নেয়া হবে না। তারপর দেশীয় অর্থায়নে ৫ বড় প্যাকেজে কাজ শুরু হয়। পদ্মার দুই অংশ ১. সাবস্ট্রাকচার ২. সুপারস্ট্রাকচার। ভূকম্পন প্রতিরোধে ৯৬ সেট ফিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যা চীনের তৈরি। সেতুর নক্সা করেছে হংকং। যেখানে ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। তদারকি নিউজিল্যান্ড যারা নক্সার প্রথম লেআউট করেছিল।
×