ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শাহজাহান মন্ডল

সাক্ষ্য আইনে পুলিশ কেন অবহেলিত

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৪ মে ২০২২

সাক্ষ্য আইনে পুলিশ কেন অবহেলিত

বাংলাদেশের পুলিশকে অতিমাত্রায় অবহেলিত করে রাখা হয়েছে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে। তবে ইংল্যাণ্ডে নয়। আমাদের সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পুলিশ অফিসারের নিকট প্রদত্ত কনফেসন (দোষ-স্বীকারোক্তি) কোন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাবে না (ঘড় পড়হভবংংরড়হ সধফব ঃড় ধ ঢ়ড়ষরপব ড়ভভরপবৎ ংযধষষ নব ঢ়ৎড়াবফ ধং ধমধরহংঃ ধ ঢ়বৎংড়হ ধপপঁংবফ ড়ভ ধহু ড়ভভবহপব)। কেউ নিজে অপরাধ করেছে মর্মে পুলিশ অফিসারের নিকট দোষ স্বীকার করলে এর ভিত্তিতে তার শাস্তি হবে না। তবে সে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট, এমনকি কোন সাধারণ মানুষের নিকট, নিজের দোষ স্বীকার করলে তার শাস্তি হতে বাধা নেই। পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নির্যাতন করে কথা আদায় করে-এমন প্রচলিত কথা থেকে পুলিশের ওপর জন-অবিশ্বাস ২৫ ধারার বিধানের কারণ। এখানে ‘পুলিশ অফিসার’ বলতে পুলিশ বাহিনীর যে কোন সদস্য অন্তর্ভুক্ত। আইজিপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই, সেই সঙ্গে গ্রাম্যচৌকিদারও এর অন্তর্ভুক্ত [(Deokinandan v. R অওজ ১৯৩৬, ওংষধস গধংঃবৎ ৭ উখজ ২০৫]। আনসার-দফাদার-গ্রাম পুলিশও এর আওতায় পড়তে পারে। তাদের যে কারও নিকট বা সামনে প্রদত্ত কনফেসন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। আসামি একজন সাধারণ লোকের নিকট কনফেসন দেয়ার সময় যদি পুলিশ অফিসার উপস্থিত থাকেন, যেমন- চৌকিদার ইত্যাদি, তাহলেও তা ২৫ ধারা দ্বারা বারিত হয়। অর্থাৎ তা আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয় না। তার ভিত্তিতে আসামির সাজাও হয় না (ইযঁষধশরৎধস কড়রৎর া. ঝ ১৯৭০)। সাক্ষ্য আইনের ২৬ ধারা বলছে, আসামি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট হাজির হলে আসামির দৃষ্টিসীমানার মধ্যে পুলিশ থাকলেও একই কথা। অর্থাৎ এমতাবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দেয়া তার দোষ-স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেও তার শাস্তি হয় না (ঔধভধৎ অষধস ঈযড়ফিযঁৎু ২০ উখজ ৬৬৬)। আসামি নিজে যদি ভিক্টিমকে খুন করেছে মর্মে দোষ-স্বীকারোক্তি লিখে থানায় এজাহার (এফ.আই.আর.) জমা দেয়, তাহলে তার ভিত্তিতেও আসামির সাজা হয় না। বিভিন্ন মামলার মাধ্যমেও বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাক্ষ্য আইন মোতাবেক এতই অবিশ্বাসযোগ্য, এতই অগুরুত্বপূর্ণ, এতই অবহেলিত আমাদের বাংলাদেশের পুলিশ! পক্ষান্তরে বিশ্বাসযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ইংল্যা-ের পুলিশ। কারণ, ইংল্যা-ে পুলিশ অফিসারের নিকট আসামি নির্যাতনবিহীন কনফেসন দিলে তার ভিত্তিতে আসামির সাজা হতে বাধা নেই। ইংল্যা-ের রাজারা যখন ১৮৭২ সালে ভারতবর্ষের জন্য এ আইন তৈরি করেন, তখন এ হীনকারী বিধান ২৫ ধারায় যুক্ত করেন। ভারতীয়রা বা বাঙালীরা নিশ্চয় তখন তা বোঝেনি। ইংল্যা-ে কনফেসন বিষয়ক বর্তমান আইনের নাম চড়ষরপব ধহফ ঈৎরসরহধষ ঊারফবহপব (চঅঈঊ) অপঃ ১৯৮৪। এটি সেদিনের আইন। এর ৭৬ ধারায় বলা আছে, নির্যাতনের মাধ্যমে কনফেসন আদায় করা হলে কিংবা কনফেসনটি অনির্ভরযোগ্য হলে তার ভিত্তিতে কনফেসরের শাস্তি হবে না। নির্যাতন যে-ই করুক না কেন, পুলিশ হতে পারে, অন্য ব্যক্তিও হতে পারে। এখানে নির্যাতনই মুখ্য। সে পুলিশ কি-না, তা মুখ্য নয়। ইংল্যান্ডের এ বিধানের মতো আমাদের সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, প্ররোচনা, ভীতি ও মামলায় সুবিধাদায়ী বা অসুবিধানাশী প্রতিশ্রুতির (inducement, threat or promise) মাধ্যমে কনফেসন আদায় করা হলে তার ভিত্তিতে কনফেসরের শাস্তি হবে না। আসামি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট কনফেসন দিলে তিনি তা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের (ঈৎ চঈ) ১৬৪ ধারা মোতাবেক লিখে নেন। এটিকে বিচারিক কনফেসন (judicial confession) বলা হয়। কারণ, তা বিচারকের নিকট দেয়া। এর ভিত্তিতে তার শাস্তি হতে বাধা নেই। মজার কথা হলো, সাধারণ লোকের নিকট আসামি যদি দোষ-স্বীকারোক্তি দেয় এবং ঐ লোক যদি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট তা বলে দেয়, তাহলে তার ভিত্তিতেও আসামির সাজা হতে পারে। এটি বিচারবহির্ভূত কনফেসন (বীঃৎধ-লঁফরপরধষ পড়হভবংংরড়হ)। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইংল্যান্ডের চঅঈঊ অপঃ-এর ৭৬ ধারায় বলা নেই যে, পুলিশ অফিসারের নিকট কনফেসন দেয়া হলে তার ভিত্তিতে আসামির সাজা হবে না। অথচ বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইনে ২৫ ধারায় তা বলা আছে। দেখা যাচ্ছে, পুলিশ অফিসারকে অবহেলিত ব্যক্তি গণ্য করেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের এ বিধান। ঐ সাধারণ লোক হলো এমন লোক যে কি-না পুলিশ নয়, হোক সে চোর-ডাকাত-ছ্যাঁচড়-কিলার-হাইজ্যাকার কিংবা ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ-মাদকসেবী-কালোবাজারি-জালিয়াত, তার নিকট আসামি দোষ-স্বীকারোক্তি দিলে তারও দাম আছে। অর্থাৎ তার ভিত্তিতে আসামির সাজা হতে পারে। কিন্তু পুলিশের নিকট দিলে কাজ হয় না। আসামির সাজা হয় না। এক্ষেত্রে একজন আইজিপির দামও চোর-ডাকাত-দুর্নীতিবাজের নিচে। দেড় শ’ বছর ধরে পুলিশ এভাবেই আইনের মাধ্যমে জনগণের নিকট অপাংক্তেয় হয়ে আছে। তারা নাকি শুধু নির্যাতন করেই কনফেসন আদায় করে। সাইকোলজিক্যাল স্কিল, ডিজিটাল যন্ত্র-পদ্ধতি-ইন্টেলিজেন্স, বোঝানোর দক্ষতা, অনুপ্রাণিতকরণ ক্ষমতা, দয়া-মায়া-ভালবাসা প্রভৃতির মাধ্যমে কনফেসন আদায় করার ক্ষমতাÑ কিছুই নাকি তাদের নেই! বিসিএস বা বিজেএস পাস করে কেউ ম্যাজিস্ট্রেট হয়, কেউ এএসপি হয়। তারা প্রমোশন পেয়ে কেউ সচিব বা জেলা জজ হন, কেউ আইজিপি হন। তাহলে কনফেসন মূল্যায়নের সময় একজনের মর্যাদা থাকবে, আরেকজনের থাকবে না কেন? ঔপনিবেশিক আমলে সেই ১৮৭২ সালে যে উদ্দেশ্যে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হবার জন্য পুলিশ নিয়োগ-মোতায়েন করা হতো, এখন তো পুরোপুরি সেই একই উদ্দেশ্যে নিয়োগ-মোতায়েন হয় না। সেসময় প্রায় অশিক্ষিত লোকদের ধরে এনে পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। এখন তো শুধু তাদের পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় না। এখন উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটদের এবং তদুর্ধ পুলিশ হতে দেখি। বিসিএসের ভাইভা নেয়ার সময় দেখেছি, এমবিবিএস বা এলএলবি ডিগ্রীধারীরাও পুলিশের এএসপি হতে ভীষণ আগ্রহী। আগে পুলিশের নাম শুনলে কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না। এখন পুলিশের এএসপি শুনলে মেয়ের বাপেরা লাফিয়ে উঠে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে। যেমন দিতে চায় জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে। ছেলের বাবারাও মেয়ে পুলিশ অফিসার পেলে তার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেয়ার জন্য তাল গাছে চড়ে। পুলিশ এখন খাকি পোশাক ছেড়ে নীল রঙের পোশাক পরছে। তারা এখন স্লোগান দেয়, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। তাহলে কেন তাদের নিকট প্রদত্ত দোষ-স্বীকারোক্তির সাক্ষ্যগত মূল্য থাকবে না? অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, পুলিশকে যথাযথ মূল্য দিলে তারা আরও বেশি জনদরদি হয়ে উঠবে। আরও বিশ্বাসযোগ্য-মর্যাদাপূর্ণ-গুরুত্বপূর্ণ মানুষে পরিণত হবে। যেমন হয়েছে ইংল্যান্ডে। বারবার ইংল্যান্ডের কথা বলছি কেন? কারণ, সাক্ষ্য আইনটা ইংরেজদের তৈরি ১৮৭২ সালে। আর সে দেশে পুলিশের মূল্যায়ন করা হয় যথাযথভাবে। সেখানে পুলিশের নিকট দেয়া আসামির দোষ-স্বীকারোক্তির সাক্ষ্যগত মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইনের মাধ্যমে। সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারায় উল্লিখিত প্ররোচনা, ভীতি বা প্রতিশ্রুতির (রহফঁপবসবহঃ, ঃযৎবধঃ ড়ৎ ঢ়ৎড়সরংব) প্রভাব আসামির মন থেকে সম্পূর্ণ উবে যাবার পর বা শেষ হয়ে যাবার পর সে ম্যাজিস্ট্রেট বা সাধারণ লোকের নিকট কনফেসন দিলে তার ভিত্তিতে শাস্তি হতে বাধা থাকে না (ঊসঢ়বৎড়ৎ া. এধহবংয ঈযধহফৎধ এড়ষফধৎ ১৯২২ ৫০ ঈধষ ১২৭, ২৮ ধারা দ্রষ্টব্য)। এক্ষেত্রে প্রশ্ন করা যায়, পুলিশের তরফ থেকে যদি আসামির ওপর এ ধরনের কোন প্রভাব না থাকে, তাহলেও কি পুলিশ একই কাতারে দাঁড়াতে পারে না? অর্থাৎ পুলিশের নিকট দেয়া কনফেসনের ওপর নির্ভর করা যায় না? এর স্বপক্ষে ২৭ ধারাতে একটু আলোকপাত করা হয়েছে। এ ধারা মতে, আসামি পুলিশকে কোন তথ্য দেয়ার পর পুলিশ তার প্রেক্ষিতে কিছু বিষয় উদ্ধার-উদ্ঘাটন করলে ঐ তথ্যটিকে কনফেসন হিসেবে গণ্য করা হয়। তখন তার ভিত্তিতে আসামির শাস্তি হয়ে থাকে। তাহলে আমাদের দেশের পুলিশ সদস্যরা অবহেলার পাত্র হয়ে থাকবেন কেন? আবুল কাসেম মামলায় (২২ উখজ ২৭৯) দেখা যায়, এজলাসে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পুলিশ অফিসার উপস্থিত ছিলেন বিধায় কয়েদির কনফেসন গৃহীত হয়নি। অথচ কেমন বৈসাদৃশ্য মনে হবে দেখুন, কোর্ট-কনস্টেবল উপস্থিত থাকলে কনফেসন গৃহীত হতে বাধা নেই (ঔধভধৎ অষধস ঈযড়ফিযঁৎু ঈধংব ২০ উখজ ৬৬৬)। এক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো যায়, প্রায় একই রঙের একই পোশাকধারী ব্যক্তিদের মধ্যে কে পুলিশ অফিসার আর কে কোর্ট-কনস্টেবল তা দুর্বল চিত্তের আসামির বোঝার ক্ষমতা সবসময় থাকবে কি? আসলে আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ব্রিটিশদের আমরা বিতাড়ণ করেছি। ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানী জান্তাকে তাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছি। অথচ ইংরেজ ও পাকিস্তানীদের মন-মেজাজ এখনও আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তাহলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে কখন? পুলিশ নির্যাতন করবে না ভাবতে কষ্ট হয় বটে। কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৭ ধারার অধীনে ম্যাজিস্ট্র্রেট যখন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে (রিমা-ে) দেন, তখন তিনি তো এটা জেনেশুনেই দেন যে, পুলিশ তাকে জামাই আদর করবে না। প্রথমত বুঝিয়ে কথা আদায় করবে, নয় তো নির্যাতন করেই কথা আদায় করবে এবং তাকে পরের দিন এমনভাবে কোর্টে হাজির করবে যে, সে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দোষ স্বীকার করবে। এমন আসামিকেও আদালত অঙ্গনে অনেকে দেখে থাকেন যার ফোলা হাত-পায়ে রক্তের দাগ থাকে, তার ওপরে জামাকাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে, এমনকি হাঁটাচলায় সমস্যা হয়। অথচ ম্যাজিস্ট্রেট যখন বলেন, দোষ স্বীকারোক্তি দিতে কেউ আপনাকে মারধর করেছে কি-না, ভয়-ভীতি বা প্রলোভন-প্রতিশ্রতি দিয়েছে কি-না তখন অকপটে সে ‘না’ বলে ফেলে। শুনে উপস্থিত অনেকেই মুচকি হাসেন বৈকি। এসব জেনেশুনেও ম্যাজিস্ট্রেট যখন আসামিকে পুলিশ-রিমা-ে দেন, তখন ঐ ম্যাজিস্ট্রেটও কি ঘটনার অংশীদার হয়ে পড়েন না? এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে এবং এজন্য সাক্ষ্য আইনের ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারার বিধান বাতিল করতে হবে। তৎসংশ্লিষ্ট (ঈৎ চঈ)-এর ১৬৪ (১) ধারার পরিবর্তন করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ‘নির্যাতন’ (ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ)-এর মাধ্যমে কনফেসন বন্ধ হওয়াটা প্রয়োজন। সে নির্যাতন যার দ্বারাই ঘটুক না কেন। ‘ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ’ বলতে বোঝানো উচিত ‘অত্যাচার এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক বা হেনস্তাকারী আচরণ’ (‘ঃড়ৎঃঁৎব ধহফ পৎঁবষ, রহযঁসধহ ড়ৎ ফবমৎধফরহম ঃৎবধঃসবহঃ’)। যেমনটি সংজ্ঞায়িত হয়েছে ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (বা টউঐজ-এর) অনুচ্ছেদ ৫-এ এবং ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (বা ওঈঈচজ-এর) অনুচ্ছেদ ৭-এ। এ আন্তর্জাতিক আইনী দলিলগুলোকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রতিশ্রুতি আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫-এ রয়েছে। উপরন্তু, ওঈঈচজ হলো এমন এক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বাংলাদেশ পার্লামেন্টে রেটিফাই করেছে এবং তদনুযায়ী বাস্তবায়ন না করলে জাতিসংঘের নিকট রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হয়। পুলিশের নিকট কৃত কনফেসনকে সাক্ষ্যগত মূল্য দেয়া হলে সে স্বেচ্ছায় নির্যাতন বন্ধ করার কথা অনেক বেশি ভাববে। অপরদিকে পুলিশকে আরও মানবিক হতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। বাবা-মা, বড় ভাই-বোন বা অভিভাবককরা কষ্ট করে পড়াশোনা করান। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অনেক সময় রক্ত বিক্রি করে, তারা ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ জোগান দেন এবং বিষয়টা তাদের কোনদিন জানতেও দেন না। তারাই যখন পাস করে পুলিশ হন, এসআই হন, ইন্সপেক্টর হন, ওসি হন, এসপি-এএসপি হন, আইজিপি হন, তখন ঐ ঘাম-রক্ত বিক্রি করা বাপ-মা-ভাই-বোন-অভিভাবক আনন্দে বুক ভাসান। এরপর যদি তারা জানতে পারেন, তাদের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে ‘মানুষ’ হওয়া ঐ ছেলেমেয়েরা তথা এখনকার পুলিশ অফিসাররা মানুষ নির্যাতনে নেমে পড়েছে, তখন তাদের সমস্ত আনন্দ আর আনন্দ থাকে কি? ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন সংশোধনের জন্য সরকার ১৪.০৩.২০২২ মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সঙ্গে বিবেচ্য হতে পারে: (ক) সাক্ষ্য আইনের ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারা বাতিল করা, (খ) ২৪ ধারায় ‘রহফঁপবসবহঃ, ঃযৎবধঃ ড়ৎ ঢ়ৎড়সরংব’ শব্দগুলোর ঠিক পূর্বে ‘ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ’ শব্দটি যাগ করা এবং এ ধারার শেষে ‘ঊীঢ়ষধহধঃরড়হ: ওহ ঃযরং ংবপঃরড়হ ‘ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ’ সবধহং ধহফ রহপষঁফবং ‘ঃড়ৎঃঁৎব ধহফ পৎঁবষ, রহযঁসধহ ড়ৎ ফবমৎধফরহম ঃৎবধঃসবহঃ’ শব্দগুলো সেট করা, (গ) ২৮ ধারায় ‘রহফঁপবসবহঃ, ঃযৎবধঃ ড়ৎ ঢ়ৎড়সরংব’ শব্দগুলোর ঠিক পূর্বে ‘ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ’ শব্দটি যোগ করা, এবং (ঘ) ঈৎ চঈ-র ১৬৪(১) ধারার কিঞ্চিত পরিবর্তন করা। আশা রাখছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করবেন। শেখ হাসিনার সৃদৃঢ় যৌক্তিক সিদ্ধান্তে বিশ্ব ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যেমন ঋণ না নিয়ে, বিশ্ব ব্যাংকের ধারণা পাল্টে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ বর্তমানে সফল ও বাস্তব, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৪ ধারায় বর্ণিত ‘অনাথ শিশুর উত্তরাধিকার’ আজ যেমন আর জ্ঞানী মুসলিমদের দ্বারা সমালোচিত হয় না, ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর আইন পাসের মাধ্যমে যেমন সতীদাহ প্রথা বাতিল হওয়াকে আজ জ্ঞানী হিন্দুরাও মেনে নিয়েছে, তেমনি সাক্ষ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে পুলিশের নিকট প্রদত্ত কনফেসনকে (পড়হভবংংরড়হ ঃড় ঢ়ড়ষরপব ড়ভভরপবৎ) সাক্ষ্যগত মূল্য প্রদান করলে তা সমাদৃত হতে সময় লাগবে না। বরং বাঙালী জাতি সভ্যতার দিকে আরেকটু এগিয়ে যাবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা থেকে ব্রিটিশ-পাকিস্তানী কূট মনোভাব অনেকটা উবে যাবে বলে আশা করা যায়। লেখক : সাবেক ডিন, আইন অনুষদ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এবং কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ
×