ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী নীহারেন্দু হোম

বঞ্চনার শিকার চা-শ্রমিক

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৪ মে ২০২২

বঞ্চনার শিকার চা-শ্রমিক

১৯২১ সালের ২০ মে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মম অত্যাচার ও শোষণ থেকে মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার চা-শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ (দেশে চলো) নামের আন্দোলনের ডাক দেয়। আন্দোলন দমাতে গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হাজার হাজার চা-শ্রমিককে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর একে একে ৯৯ বছর কেটেছে। কিন্তু নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিষাদময় স্মৃতি বংশ পরম্পরায় এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন প্রায় ৭ লাখ চা-শ্রমিক। কিন্তু আজও এই দিনটির কোন জাতীয় স্বীকৃতি তারা পায়নি। ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক ইংরেজ কর্মকর্তার বাবুর্চি ওয়ারিয়া করিমগঞ্জের সিলেরচর এলাকার একটি টিলায় প্রথম অপরিচিত গাছ দেখে তার সাহেবকে জানালে ওই ইংরেজ কর্মকর্তা সেটিকে চা গাছ হিসেবে শনাক্ত করেন। এরপর ইংরেজ কোম্পানিই এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। প্রথমে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, তারপর চট্টগ্রামসহ দেশের আরও কয়েকটি এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। এরপর চা শিল্প করার জন্য ভারতের অসম, উড়িশ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। বড় বড় পাহাড় পরিষ্কার করে চা গাছ রোপণ করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোন পরিসংখ্যান ব্রিটিশরা রেখে যায়নি। তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা প-িত দেওশারন ও গঙ্গা দীতি ১৯২১ সালের ২০ মে চা-শ্রমিকরা ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনের ডাক দেয়। সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক সিলেট রেলস্টেশন থেকে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছে। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশরা গুলি চালিয়ে হাজার হাজার চা-শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সেখান থেকে অনেক শ্রমিক পালিয়ে এলেও আন্দোলন করার অপরাধে তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা পরাগ বাড়ই বলেন, চা-শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা-শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। বর্তমান শ্রমিকবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা-শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন-তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, চা-শ্রমিকদের ২০ দফা দাবি মালিকপক্ষকে লিখিত দেয়ার পর কয়েক দফা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। তবে মালিকপক্ষ কালক্ষেপণ করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। এরপর থেকে ওই দিনটি চা-শ্রমিকরা ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে এ বছরও ২০ মে চা-শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। সকাল ৭টায় সিলেটের সব চা-বাগানে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচী পালন করা হয়। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন দিবসটি উপলক্ষে মালিক ও সরকারের চা-শ্রমিকদের দৈনিক মুজরি ৪০০ টাকা নির্ধারণসহ সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা প্রদান, রেশন সপ্তাহে ৫ কেজি চাল, প্রতি মাসে ২ কেজি চা পাতা, নিরিখের অতিরিক্ত কাঁচা পাতার দ্বিগুণ মূল্য, অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চা-শ্রমিকদের বসতবাড়ি ও কৃষি জমির স্থায়ী মালিকানা প্রদানসহ ২০ মে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন এবং ওই দিন চা বাগানে ছুটি ঘোষণা। লেখক : সাংবাদিক
×