ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ছুটি খাঁ মসজিদ’

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ২১ মে ২০২২

‘ছুটি খাঁ মসজিদ’

আজও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো আমলের নিদর্শনগুলো। শেকড় সন্ধানীদের নিরাশ করে না এই স্মৃতিচিহ্নগুলো। পরম আন্তরিকতায় হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। বলা হয়েছে ছুটি খাঁ মসজিদের কথা। এই অঞ্চলের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাংলা বিভক্ত ছিল বিভিন্ন অংশে। এক এক অংশ ছিল এক এক রাজার পরাক্রম। সমগ্র অঞ্চল বিভক্ত ছিল পাঁচটি প্রাচীন জনপদে। পুন্ড্র, গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল। এর মধ্যে হরিকেল জনপদের একটি অংশ হচ্ছে আজকের বৃহত্তর চট্টগ্রাম। কথিত আছে, বার জন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আউলিয়ার সম্মেলন হয় এই চট্টগ্রামের মাটিতে। তারা একসময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের (আরাকান সড়ক/ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) একটি জায়গায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন কে কোন জায়গায় ধর্ম প্রচারের জন্য যাবেন। আর তাই এই স্থানটির নাম হয়ে যায় ‘বারো আউলিয়া’। বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার আশপাশের এলাকায় অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এরকম আরও অনেক স্থান। মীরসরাই উপজেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। সরেজমিনে দেখা যায়, মীরসরাই উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হলো জোরারগঞ্জ। এই বাজারের উত্তর দিকে অবস্থিত শাহী আমল তথা ইরানি মুসলিম শাসনামলের নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন এই ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের প্রায় ৬শ’ বছরের পুরনো ছুটি খাঁ মসজিদ। পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পাশে জোরারগঞ্জ বাজারের দুইশ গজ উত্তরে দেওয়ানপুর গ্রামে ছুটি খাঁ দীঘির পাড়ে এর অবস্থান। জানা যায়, গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন লস্কর পরাগল খাঁ তারপরে শাসনকর্তা হন তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ। পরাগল খাঁর পিতা রুকনুদ্দীন বারবাক শাহের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। পরাগল খাঁ আর ছুটি খাঁর শাসনামলে চট্টগ্রামের শাসনকেন্দ্র ছিল পরাগলপুর। নাম শুনেই বোঝা যায় শাসনকর্তার নামানুসারেই পরাগলপুরের নামকরণ করা হয়েছে। প্রাচীন রাজারা প্রজাদরদী ছিলেন। নিজেদের সুনাম ও প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করতেন। এলাকার পানীয় জলের অভাব মেটাতে তারা বিশালাকার দীঘি খনন করতেন। মুসলিমদের জন্য সুদৃশ্য মসজিদ আর হিন্দুদের জন্য নয়নাভিরাম মন্দির নির্মাণ করতেন তারা। ছুটি খাঁ-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর শাসনামলে জোরারগঞ্জসহ আশপাশের কিছু অঞ্চলে দীঘি খনন ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দেওয়ানপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ছুটি খাঁ মসজিদটি তারই সুশাসনের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। মসজিদের পার্শ্ববর্তী দীঘিটি নিয়েও রয়েছে মজার ইতিহাস। এটা আবার অনেক এলাকায় প্রচলিত জনশ্রুতির মতোই। ধারণা করা হতো, একদল জিন এই দীঘির নিচে বাস করতো। তারা ছিল অগাধ সম্পদের মালিক। এদেরকে অনেক এলাকাতে বলে যক্ষ। শোনা যায়, মসজিদের পাশের এই দীঘিতে এলাকার কোন অনুষ্ঠানের যেমন- বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠানাদি এলে দীঘির পাড়ে মাটি দিয়ে লেপে প্রয়োজনীয় থালা বাসনের সংখ্যা লিখে প্রার্থনা করলে পরের দিন সকালে তা নৌকাসহ ভাসতে দেখা যেত। প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার নৌকাতে রেখে দিলে তা ডুবে যেত। কিন্তু কেউ যদি একটা থালা বাসন কম দিত তাহলে নৌকা ডুবতো না পাশাপাশি তার ক্ষতি হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ঐতিহাসিক ছুটি খাঁ মসজিদের খতিব নূরুল আলম তৌহিদী জানান, ‘পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যেসকল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর অন্যতম একটি নিদর্শন ছুটি খাঁ মসজিদ। মূল মসজিদটি অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। পরবর্তীতে নতুনভাবে মসজিদ ভবনটি নির্মাণ করা হয়। মূল মসজিদের বেশ কিছু ছোট বড় পাথর শিলালিপি সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহের কিছু সংরক্ষণ করেছে। মূল মসজিদ তৈরিতে ব্যবহৃত পাথরগুলো ভারতের রাজস্থান ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আনা হয়েছে বলে জানা যায়। কালো রঙের নানা ডিজাইন ও আকৃতির কিছু পাথর এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মসজিদের আঙ্গিনায়। মসজিদের ভেতরে একাধিক শিলালিপির একটিতে সুন্দর লিখনচিত্র (ক্যালিওগ্রাফি) পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে আয়াতুল কুরশী লিখিত আছে।’ কবি ও গবেষক মাহমুদ নজরুল বলেন, ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বিভিন্ন বইয়ে ছুটি খাঁ মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। এসব বইয়ে লেখা আছে ছুটি খাঁ মসজিদ খোদিত পাথরের ব্লক দিয়ে নির্মিত ছিল। তবে মসজিদটির নির্মাতা পরাগল খাঁ, না ছুটি খাঁ এ বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ১৫১৫ খ্রীঃ এর পরবর্তী সময়ে এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ আছে।’ জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মাস্টার বলেন, প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ছুটি খাঁ মসজিদটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস এবং একই সঙ্গে তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবে। এ স্মৃতি রক্ষার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। রাজিব মজুমদার, মীরসরাই, চট্টগ্রাম
×