ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

মানি লন্ডারিং ও পি কে হালদার

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২০ মে ২০২২

মানি লন্ডারিং ও পি কে হালদার

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধীদের ধরন ও অপরাধের বৈচিত্র্যও বিচিত্রভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যাচ্ছে। যেমন বলা যায়, একটা সময়ে নারীরা সহজে অপরাধের সঙ্গে জড়িত হতো না। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় নারীরা শুধু অপরাধেই জড়িত হচ্ছে না, জড়িত হচ্ছে ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ সব ধরনের অপরাধে। আবার দেখা যেত, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয় এবং লেখাপড়ায় ঘাটতি রয়েছে অর্থাৎ কম শিক্ষিত, তারাই শুধু অপরাধে জড়িত। অবশ্য তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা প্রবল পরিমাণে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত মানুষেরাও অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। শুধু যে জড়িত হচ্ছে বিষয়টা তেমন নয়, বরং বড় বড় ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ তারা তাদের পদ-পদবি, যোগ্যতা ও সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ জনগণের চোখে ধুলা দিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল অংকের টাকা আত্মসাত এবং পাচার করে দিচ্ছে। সারা জীবনের জন্য নিজের আখের গোছাচ্ছে। এ প্রকৃতির লোকেরাই দেশের বাইরে টাকা পাচার করে বাড়ি গাড়ি ক্রয় করছে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে বিদেশে। পরিণত হচ্ছে ব্যাপক বিত্তশালীতে। পি কে হালদারকে ভারতে গ্রেফতারের পরে এক ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে দেশে-বিদেশে। জনমানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভের। তিনি বাংলাদেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন, একাধিক ডিগ্রীও নিয়েছেন। এ ধরনের মানুষের নৈতিক স্খলনের সর্বোচ্চ অধঃপতনের বহির্প্রকাশ দেখে সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ, দুশ্চিন্তা ও দ্বিধাগ্রস্ত। কেননা, স্বাভাবিকভাবে অভিভাবকদের মধ্যে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করলে আর যাই হোক দেশবিরোধী কর্মকা-ে অংশ নেবে না। কিন্তু সে ধারণাও দিনে দিনে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। যে কোন প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীর নৈতিক স্খলনের অহরহ ঘটনার প্রতিচিত্র মানুষের আস্থার জায়গাকে প্রায় নিঃশেষ করে দিচ্ছে। অভিভাবকদের এমনিতেই সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তথাপি পি কে হালদারদের মতো ভয়ঙ্কর কলুষিত চরিত্র তাদের দুশ্চিন্তাকে আরও বৃদ্ধি করছে। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে জানা যায়, পি কে হালদার অস্তিত্বহীন ৩০-৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণের নামে জালিয়াতি করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড ও পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে আত্মসাত করেছেন প্রায় ১০ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে দুই হাজার ৫০০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি ও পিপলস লিজিং থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা জরুরী। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকিতে নিয়োজিত সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একবার যদি এ ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত সকল কিছুই নিয়ন্ত্রণ ও সততার মধ্যে চলে আসতে বাধ্য। ঘটনাক্রমে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশান্ত কুমার হালদারকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেফতারের পর কয়েক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগনা জেলা থেকে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হলে তা মঞ্জুর করা হয়। গভীর রাতে স্পেশাল ইডি থেকে পি কে হালদারের রিমান্ড আবেদন করা হলে বিজ্ঞ আদালত তা মঞ্জুর করে। পি কে হালদারের পাঁচ সহযোগীর মধ্যে চারজনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছে আদালত। পরে পি কে হালদারকে ইডি হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর আগে পশ্চিববঙ্গের বিভিন্নস্থানে পি কে হালদারের প্রাসাদোপম বাড়িসহ অনেক সম্পদের সন্ধান পায় ইডি। সংস্থাটি পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের সম্পদের সন্ধানে অন্তত ১০টি স্থানে অভিযান চালিয়েছে। প্রধানত আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেআইনীভাবে ভারতে অর্থ পাঠানো, বিদেশে অর্থ পাচার এবং আইনবহির্ভূত সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত করছে ইডি। অবশ্য এ পর্যন্ত কত বাড়ি, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হদিস পাওয়া গেছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। পি কে হালদাররা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে তাদের অপরাধ কর্মকা-গুলো সংঘটিত করে থাকে। এর পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সঙ্গেও একটি যোগসূত্র রক্ষা করে চলে। এ ধরনের অপরাধ চক্রের সদস্যরা সীমান্ত এলাকায়ও বিশেষ ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। নিরাপত্তারক্ষী এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষের সঙ্গে অপরাধ চক্রের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়। এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তারা সকল ধরনের অপকর্ম সাধন করে থাকে। মানি লন্ডারিংয়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা স্বীকার করে পুরো পৃথিবী। বর্তমানে এটি একটি অন্যতম বৈশ্বিক সমস্যা। হুন্ডি ব্যবসা, অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ আয়, অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্তরাই সাধারণত এ অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কর্মকর্তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় পি কে হালদারকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা অভিযানের সময় পি কে হালদারের কাছ থেকে সম্পত্তি এবং জমির দলিলসহ কিছু কাগজপত্র জব্দ করেছেন, যার মধ্যে ২০ থেকে ২২টির মতো বাড়ির মালিকানার তথ্য মিলেছে। পি কে হালদার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পৌঁছান। কৌশলে ভুয়া ভারতীয় ভোটার, প্যান এবং আধার কার্ড সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। শিব শঙ্কর হালদার নামে উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরে বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন। ইডির এক কর্মকর্তা বলেছেন, তার সহযোগীরাও একই ধরনের ভুয়া ভারতীয় ভোটার, প্যান ও আধার কার্ড সংগ্রহ করে অশোকনগরে নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন। ভারতীয় এই আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, পি কে হালদারকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের পেছনে দুটি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বাংলাদেশের আর্থিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধ। অন্যটি তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এ মানি লন্ডারিং মানে- অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন বা ছদ্মাবৃত্ত করা। এছাড়া, সম্পৃক্ত অপরাধ সংগঠনে জড়িত কোন ব্যক্তিকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ হতে রক্ষার উদ্দেশ্যে সহায়তা করা; অথবা বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার করা। জ্ঞাতসারে অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে এর হস্তান্তর, বিদেশে প্রেরণ বা বিদেশ হতে বাংলাদেশে প্রেরণ বা আনয়ন করা। কোন আর্থিক লেনদেন এইরূপভাবে সম্পন্ন করা বা সম্পন্ন করার চেষ্টা করা যাতে এই আইনের অধীন তা রিপোর্ট করার প্রয়োজন হবে না; সম্পৃক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচিত করা বা সহায়তা করার অভিপ্রায়ে কোন বৈধ বা অবৈধ সম্পত্তির রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করা; সম্পৃক্ত অপরাধ হতে অর্জিত জানা সত্ত্বেও এই ধরনের সম্পত্তি গ্রহণ, দখলে নেয়া বা ভোগ করা। কাজেই বলা যায়, পি কে হালদার এবং তার প্রত্যেক সহযোগী মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রিকায় অর্থপাচারের বিভিন্ন ধরনের খবরে আঁতকে ওঠে যে কোন সচেতন নাগরিকের মন। আমাদের দেশ থেকে অবলীলায় বাইরে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা খুবই দুশ্চিন্তার ও উদ্বেকের। কাজেই যে কোন মূল্যে মানি লন্ডারিং বন্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। মানি লন্ডারিংয়ের কারণে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ঘটনা যেমনি ঘটে, ঠিক তেমনি সহিংস ঘটনাগুলোর সঙ্গেও বিষয়টির যোগসূত্র রয়েছে। কাজেই জিরো টলারেন্স গ্রহণ করা ব্যতীত ভিন্ন পন্থা এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি আর নেই। দেশে মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিচারকার্য নিশ্চিত করতে হবে। এ কথাও সত্য যে, মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যারা জড়িত তারা বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে লিয়াজোঁ বজায় রেখে তাদের অপকর্ম করার দুঃসাহস দেখায়। ঘটনায় দেখা যায়, পি কে হালদারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তার সখ্য গড়ে উঠেছিল এবং তারাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। কাজেই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে অবিলম্বে। কোন ব্যক্তি মানি লন্ডারিং অপরাধ করলে বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করলে তিনি অন্যূন ৪ (চার) বৎসর এবং অনধিক ১২ (বারো) বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এর অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত বা অধিক অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে শর্ত থাকে যে, আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত সময়সীমার মধ্যে অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হলে আদালত অপরিশোধিত অর্থদণ্ডের পরিমাণ বিবেচনায় অতিরিক্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার আদেশ প্রদান করতে পারবে। কাজেই রাঘব বোয়ালদের শক্ত হাতে দমনের জন্য আইনের শাসনের সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন অজুহাতে প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে অপরাধীদের ফোকাস ভিন্ন দিকে চলে যায়। মিডিয়াও অনেক ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক বিষয়ই ধামাচাপা পড়ে যায়। আবার এমনও দেখা যায়, ধামাচাপা পড়ে যাওয়া বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সরব হয়ে পড়ে এবং প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পায় তথা রাষ্ট্র সত্যানুসন্ধান করে শাস্তি দিয়ে থাকে। এ ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তাদেরকেও সোচ্চার হতে হবে অপরাধীদের সর্বতোভাবে দমনের জন্য। লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×