ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হাদিস শাস্ত্রের মহান সাধক ইমাম আবু দাউদ (রহ.)

প্রকাশিত: ২১:০৩, ২০ মে ২০২২

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হাদিস শাস্ত্রের মহান সাধক ইমাম আবু দাউদ (রহ.)

ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোতে বসরা নগরে এই শাওয়াল মাসে ইন্তেকাল করেছেন এক মহান মুসলিম মনীষী ইমাম আবু দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। ইমাম অর্থ নেতা বা শীর্ষ ব্যক্তি। মসজিদে নামাজ কায়েমে যিনি মূল ব্যক্তি তাকে ইমাম বলা হয়, মুসলিম দেশের কর্ণধারকেও ইমাম বলা হয়। এভাবে যারা ধর্মের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকে নেতৃত্ব প্রদান করেন তাদেরকে এ নামে স্মরণ ও বরণ করা হয়। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) ছিলেন হাদিস শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান ইমাম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের জন্য আমি দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ এ দুটো আঁকড়ে থাকবে বিভ্রান্ত হবে না। এক. আল্লাহর কিতাব কোরআন শরীফ, দুই. রাসুলের হাদিস। সুখের কথা হলো, আজও এগুলো সত্যি আমাদের কাছে অক্ষত ও অকৃত্রিম অবস্থায় মজুদ রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত আসতে অনেক ঝুঁকি ও শ্রমের প্রয়োজন হয়েছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওফাতের পর কতিপয় ভ- নবীর উদ্ভব ও ধর্মের নামে নানা মিথ্যা, আজগুবি আকর্ষণীয় বাণীর ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এ থেকে প্রকৃত বাণীগুলো উদ্ধারের জন্য রীতিমতো সাধনা করেছেন যে কজনা, তাদের মধ্যে ইমাম আবু দাউদ একজন। তিনি সঙ্কলন করেছেন মহানবী (সা.) এর বাণী ও জীবনীর এক বিরাট অংশ। সঙ্কলনটির নাম সুনানি আবু দাউদ। হাদিস শাস্ত্রে তার একনিষ্ঠ সাধনার জন্য বলা হয়ে থাকেÑ ইমাম আবু দাউদ দুনিয়াতে যেন হাদিসের জন্য আর আখেরাতে বেহেস্তের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন। উল্লেখ্য, পাঁচ লাখ হাদিস থেকে যাচাই বাছাই করে তার গ্রন্থে চার হাজার আট শ’ হাদিস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র হাদিস ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস। নবীজীর জামানায় কুরআনের বাণী ও হাদিসের বাণী মিশে যাবে মনে করে হাদিস লিপিবদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। খলিফা উমর ইবনুল আবদুল আজিজের (রহঃ) সময়ে হিজরী একশত সালের শুরুতে সরকারীভাবে হাদিস লেখার নির্দেশ জারি করা হয়। তখন সর্বপ্রথম যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন তিনি ছিলেন হিজাজ ও সিরিয়ার আলিম মুহাম্মদ ইবনে শিহাব জুহুরী (রহঃ)। এরপর যাদের নাম আসে ইবনে জুয়াইজ, হাম্মাদ ইবনে সালিমাহ, ইবনুল মোবারক (রহঃ) প্রমুখ। হিজরী তৃতীয় শতাব্দী ছিল হাদিস সঙ্কলনের স্বর্ণযুগ। এ শতকের মুহাদ্দিস ও হাদিস বর্ণনাকারীগণ হাদিসের সন্ধানে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করেছেন। প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য হাদিসগুলোকে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেন। হাদিস শাস্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট ছয় খানা হাদিস গ্রন্থ ‘সিহাহ সিত্তাহ’ এ শতকেই সঙ্কলিত হয়। হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম জাহানের প্রায় সর্বত্রই হাদিসের ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। তন্মধ্যে খোরাসান ও মাÑওয়ারাতুন নাহার ছিলেন অতি মশহুর। এ রতœপ্রসবিনী এলাকা হাদিস ও আইনশাস্ত্রে এমন গুণী ব্যক্তিদের জন্ম দেন যাদের তুলনা মুসলিম জগতে বিরল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এ অঞ্চলেই হাদিস শাস্ত্রের ছয় প্রধান শীর্ষ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। তারা হলেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী, ইমাম তিরমিজি ও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মাজাহ (রহঃ)। ইমাম আবু দাউদের আসল নাম সোলাইমান। আরবের প্রসিদ্ধ আযদ গোত্রে সিজিস্থান নামক স্থানে ২০২/৮১৭ সালে তার জন্ম। নিজ গ্রামেই বাল্য শিক্ষালাভ করেন তিনি। এরপর উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য নিশাপুর, বসরা, কুফা, মিসর, সিরিয়া, হিজাজ প্রভৃতি দেশ-প্রদেশ ভ্রমণ করেন। অসংখ্য ওস্তাদ হতে তিনি আপন জ্ঞানভা-ার সমৃদ্ধ করেছেন। বিখ্যাত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) ছিলেন তার অন্যতম ওস্তাদ। ইমাম তিরমিজি এবং ইমাম নাসায়ী (রহঃ) দুজনেই ছিলেন তার সাগরেদ। শুধু জ্ঞানের জন্য নয়, খোদাভীরু, সততা এবং কর্তব্যনিষ্ঠ চরিত্র মাধুর্যের জন্য তিনি গোটা আরবের জন্য একজন আদর্শ শিক্ষকের মর্যাদায় আসীন হন। আজকের যুগে শিক্ষক সমাজে যে গুণগুলোর তীব্র্র অভাব পরিলক্ষিত হয় তার অনেক বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছিল। আজকাল শিক্ষকদের মধ্যে খুব কমই আছেন যারা সর্বসাধারণের অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারেন। বিশেষ করে নীতি নৈতিকতার দিক দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি দরদ ও দায়িত্ব প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আজকালকার শিক্ষকরা যেন দায়সারা। অথচ তখনকার ওস্তাদশ্রেণী ছিল আদর্শ ও গুণেমানে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যম-িত। তখনকার এক একজন শিক্ষক যেন এক একটি প্রতিষ্ঠান। এক একটি বিষয়ের দিকপাল। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) ছিলেন দ্বীনি শিক্ষা ও হাদিস শাস্ত্রের জগতে তেমনি এক আদর্শ ও বহুমাত্রিক পুরুষ। তার শিক্ষার দ্বার ছিল সবার জন্য অবধারিত। একবার তার শরণাপন্ন হয়েছিলেন মুসলিম শাসক আল মুয়াফফিক। তিনি ইমামের কাছে তিনটি আরজ রাখেন: ১. রাজনৈতিক কারণে বসরা নগরী জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে আবার এ শহরমুখী করার জন্য তার মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের অবস্থান জরুরী। ২. তিনি আপন সন্তানদের উদ্দেশে ইমামকে হাদিস শিক্ষাদানের জন্য অনুরোধ জানান। ৩. ইমাম সাহেব খলিফা মুয়াফফিকের সন্তানদের জন্য হাদিসের এমন বিশেষ ক্লাস নিবেন যেখানে সাধারণ ছাত্রদের অংশগ্রহণ থাকবে না। ইমাম আবু দাউদ শাসকের প্রথম দুটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষোক্ত অনুরোধটি রক্ষা করতে পারলেন না। কারণ, ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) ধনী, গরিব, শাসক-প্রজা কোন বিশেষ শ্রেণীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন না। একজন আদর্শ জনদরদী শিক্ষাবিদ ও সমাজহিতৈষী হিসেবে ইমাম আবু দাউদের (রহঃ) উচ্চ আসন ওপরের ছোট্ট ঘটনা থেকে পরিমাপ করা যায়। আমরা আগেই বলেছিলাম সে যুগে শিক্ষকদের আকাশসম চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা। বিশেষ করে ইমাম আবু দাউদ অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে মুসলিম জাহানের কল্যাণকর চিন্তা করতে পেরেছিলেন। সীমিত কোন গ-ি নিয়ে তার ভাবনার সময় ছিল না। তাই আজ হাদিস শাস্ত্রের অন্যতম সেরা সাধকপুরুষ হিসেবে গোটা মুসলিম উম্মাহ তাকে স্মরণ ও বরণ করছে। এ বিষয়ে তার পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা এত বেশি যে, অনন্তকাল পর্যন্ত একজন আদর্শ শিক্ষক ও হাদিস বিশারদ হিসেবে উম্মতের ওলামা শ্রেণী শ্রদ্ধার সঙ্গে তার কথা মনে রাখবে। আল্লাহ পাক এ মহান মুসলিম মনীষীর জীবন কথা আমাদের স্মরণ রাখার তাওফিক দিন এবং বিশেষত তার মহামূল্যবান হাদিস সঙ্কলন আবু দাউদ শরীফ অধ্যয়ন করে নবীজীর (সা.) বাণীসুধা পান করার তাওফিক দান করুন। তার বর্ণিত কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো : ইসলামে নারীর অধিকার স¤পর্কীয় : হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তির ঘরে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে যেন তাকে জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায় জীবিত কবর না দেয় এবং তাকে তুচ্ছ মনে না করে, আর পুত্র সন্তানকে উক্ত কন্যা সন্তানের ওপর প্রাধান্য না দেয়, তাহলে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। হাকিম ইবনে মুয়াবিয়া (রাঃ) তার পিতা মুয়াবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞেস করেছিলাম হে আল্লাহর রাসূল, স্বামীর ওপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে? তিনি বললেন, তার অধিকার হলো যখন তুমি খাবে তখন তাকেও খাওয়াবে, তুমি যখন যে মানের কাপড় পড়বে তাকেও সে মানের কাপড় পড়াবে। তার মুখে আঘাত করবে না। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করবে না, গৃহ ব্যতীত অন্য কোথাও তার সঙ্গে স¤পর্ক ছেদ করবে না। অমুসলিমের অধিকার স¤পর্কে হাদিস: নবী করীম (সা.) বলেছেন মনে রেখো, যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোন বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব। ব্যবসা স¤পর্কে হাদিস : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, কারবারের দুই অংশীদারের কোন একজন যে পর্যন্ত খেয়ানতে লিপ্ত না হয় সে পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গেই অবস্থান করি। কিন্তু তাদের কেউ যখন খেয়ানত শুরু করে, তখন আমি তাদেরকে পরিত্যাগ করি। অন্য এক বর্ণনা মতে, তখন তাদের মাঝখানে শয়তান এসে যায়। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]
×