ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শামিম আহমেদ

টরেন্টোর চিঠি ॥ এ বসন্ত কেবলই মানসপটে

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ১৮ মে ২০২২

টরেন্টোর চিঠি ॥ এ বসন্ত কেবলই মানসপটে

পনেরো মে রাতে টরেন্টোসহ প্রায় কানাডাজুড়ে ব্লাড মুন বা রক্তাক্ত চাঁদ দেখা যাবে এমনটা পড়ছিলাম পত্রপত্রিকায় গত একসপ্তাহ ধরে। কোন্ সময়ে সবচেয়ে ভাল দেখা যাবে, কোথায় গেলে ভাল দেখা যাবে, তাও লেখা দেখেছি নানা জায়গায়। তবে কানাডায় যেহেতু অনেক বছর হয়ে গেল এখন আর এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব আশাবাদী হই না। কারণ, প্রকৃতি এ দেশকে যেমন দু’হাতে দিয়েছে, তেমনই অনেক কিছুই দেয়নি। যেমন প্রায়ই দেখেছি এখানে পূর্ণিমার রাতে বৃষ্টি হয়। ঝুমঝুম বৃষ্টি নয়, টিপটিপে ঠা-া একটা বৃষ্টি, যার কোন আবেদন নেই আমার কাছে। বৃষ্টি না হলে আকাশ মেঘে ঢাকা থাকবে। যাই হোক না কেন, পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখা যাবে– এ টরেন্টোতে হবার জো নেই। তেমনি রক্তাক্ত চাঁদ দেখা যাবে, এমনটা আমি ভাবিনি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে লেখা ছিল হালকা-পলকা বৃষ্টি হতে পারে। তা হয়নি। তবে আকাশ মেঘলা ছিল, যে সময়টা চাঁদের শাদা থেকে গোলাপি রঙ ধারণ করবার কথা, তার ঘণ্টাখানেক আগেই সে মেঘের আড়ালে চলে গেল। এ আর অবাক হবার কী! স্বাভাবিকই। রবিবার রাতের কথা বলছি। শুরুতে ভেবেছিলাম গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব দূরের কোন খোলা জায়গায়, চাঁদের এই রক্তিম খেলা দেখার জন্য। কিন্তু পরে দুটা কথা ভেবে এ পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলাম। প্রথমত, কানাডার আবহাওয়ার সঙ্গে আমার মিতালি নেই। অহেতুকই প্রস্তুতি নিয়ে যাব, তারপর দেখা যাবে কিছু একটা গোলমাল হলো। দ্বিতীয়ত, পরের দিনই সোমবার। সকালে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দেয়া থেকে দীর্ঘ সপ্তাহের শুরু হবে, তার জন্য শারীরিক বিশ্রাম ও মানসিক প্রস্তুতির দরকার আছে। অল্প সময়ে শরীরের ওপরই সবটার দায় চাপিয়ে দিলেও এবেলায় এসে বুঝি মনের বিশ্রামটাও খুব জরুরী। মনটা যে শরীরের মতোই জরুরী সেটা জানতে শিখেছি খুব বেশিদিন নয়। যেমন, ধরুন এবার রোজার ঈদের কিছুদিন পরই ফেসবুক একাউন্টটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলাম। কারণ, আর কিছু না, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে চাঙ্গা রাখার প্রয়াস। ফেসবুকের কারণে মানুষের জীবনে এখন দু’ধরনের বন্ধু। এক ধরনের বন্ধু বাস্তবের বন্ধু, রক্ত মাংসের। যাদের সঙ্গে আপনি বেড়ে উঠেছেন, সময় কাটিয়েছেন, বহু পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে জীবনের নানা রঙ রূপের বোঝা-পড়া শেষ করে বন্ধু নামের মহার্ঘ্য বস্তুটি বুঝে নিয়েছেন। অন্যদিকে ফেসবুকের বন্ধুত্ব যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গানটির মতো, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তর লজ্জা।’ ফেসবুক চালাতে প্রাণ চায়, কিন্তু মানুষে মানুষে অকারণে হানাহানি, সংঘাত, বাগ্বিত-া দেখলে মনে হয় পালিয়ে বাঁচি, এসব যে দেখবার নয়। মিথ্যা সাজসজ্জা, যা নই তা দেখাবার চেষ্টা- এইসব রবি ঠাকুর বলে গেছেন বহু আগে ‘মাল্য যে দংশিছে হায় তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা!’। ফেসবুকের আজ এমনই দশা। এ যেন বানরের গলায় মুক্তার মালা। বন্ধুত্বকে এত সহজে সস্তা বানিয়ে দিয়েছি আমরা নিজেদের অজান্তে। তাই এহেন বস্তু থেকে খানিক বিরতি নেয়া নিজের জন্য ভাল বোধ করি। রবি ঠাকুর শত বছর আগে যেভাবে বাঙালীই কেবল নয়, বিশ্ব মানুষের মনস্তত্ত্বের কথা বলে গেছেন, তা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল একটি সাম্প্রতিক কর্মযজ্ঞের কথা। ‘ফিউচার লাইব্রেরি’ নামে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববরেণ্য ১০০ জন সাহিত্যিক প্রতিবছর একটি করে বই লিখবেন। কিন্তু ২১১৪ সালের আগে এই বইগুলো কোথাও প্রকাশিত হবে না। এই ১০০টি বই একত্রে প্রকাশিত হবে ২১১৪ সালে। এই প্রকল্পের জন্য নরওয়ের নর্ডমার্কা জঙ্গলে ১০০০টি গাছ লাগানো হয়েছে। একশ’ বছর পর এই গাছগুলো থেকে প্রস্তুতকৃত কাগজ দিয়ে প্রকাশিত হবে সীমিত সংখ্যার এই ১০০টি বই। এই ১০০টি পা-ুলিপি ২১১৪ সালের আগে কেউ পড়বে না, প্রকাশিত হওয়া তো দূরের কথা, এই প্রকল্পটিকে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে গোপন পাঠাগার। এই যে এই প্রকল্পটি নিয়ে লিখছি; লিখতে লিখতে শিহরিত হচ্ছি। গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। দু’হাজার একশত চোদ্দ সালে আমার বেঁচে থাকবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই বইগুলো আমার কখনও পড়া হবে না। কিন্তু এই যে একটি অদ্ভুত সুন্দর অজানা ভবিষ্যতের জন্য মানুষের প্রস্তুতি, তা আমাকে সীমাহীন আনন্দ দেয়। আজ থেকে শত বছর পরের মানুষ শত বছর আগের সেরা সাহিত্যিকদের লেখা পড়বেন, ভবিষ্যত নিয়ে তাদের ভাবনা জেনে কী প্রতিক্রিয়া দেবেন, জানতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু হায়! মানবজনম বড্ড ক্ষণস্থায়ী, এ স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তবে নিজেকে ভাগ্যবান বলতে পারি রবি ঠাকুরের মতো একজন প্রজ্ঞাবান মনীষীর ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে– আজি হতে শতবর্ষ পরে’ পড়বার সুযোগ হয়েছে। একজন সাহিত্যিক বাংলা তেরো শতকে একশ’ বছর পরের পাঠকের চিন্তার দ্বার খুলতে পেরেছিলেন, সেই দ্বার যে আমাদেরই উঠোনে বাঁধা ছিল, এই সৌভাগ্যটাই বা কজনার হয়! কোন এক বুধবার সকালে যখন এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই আমার জনকণ্ঠের পাঠকদের সঙ্গে, তখন সেই আনন্দ বেড়ে যায় আরও বহুগুণে। এই প্রকল্পের জন্য ২০১৪ সালে নির্বাচিত করা হয় কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক মার্গারেট এটউডকে। ২০১৯ সালে যখন শেষবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে কবি মারুফ রায়হানের সঙ্গে সাক্ষাতকারে কানাডিয়ান এই ঔপন্যাসিক ও বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ও জনপ্রিয় কানাডিয়ান কবি রূপি কৌরকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সাহিত্য আগের মতো তার শিল্পসুধা ছড়ালেও তেলের দাম বাধ সাধছে তাতে। সে রান্নার তেলই হোক কিংবা গাড়ি চালানোর তেলই হোক না কেন। সোমবার সকালবেলা পেট্রো কানাডার স্টেশনে গ্যাসের দাম ছিল প্রতিলিটার দুই ডলার নিরানব্বই সেন্ট করে। বাংলাদেশী টাকায় প্রতিলিটার প্রায় দুশ’ দশ টাকার মতো। তেলের রাজ্যে বাস করে, তেলের দেশে এসে বাংলাদেশের চাইতে বেশি দামে তেল কিনে গাড়ি চালাতে হবে এ স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। রান্নার তেলের কথা যদি বলতে বলেন, কানাডায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য মানুষ রান্নায় বেশি ব্যবহার করে ক্যানোলার তেল। আজ থেকে বছর তিনেক আগেও তিন লিটারের ক্যানোলা তেলের জারের দাম ছিল ছয় ডলারের নিচে। বর্তমানে সেই তেলের দাম স্থানভেদে বারো থেকে ষোলো ডলার। স্থানভেদে বলছি কারণ, এখানকার একেক সুপারস্টোরে একই জিনিসের ভিন্ন দাম হয়। সুপারস্টোরের লোকেশন, এলাকার ভাও বুঝে, শ্রমিকের মূল্য গুনে তবেই নির্ধারিত হয় দাম। অথচ এই ক্যানোলা যে রাশিয়া বা ইউক্রেনে বেশি উৎপন্ন হয় এমনটিও নয়। ক্যানোলা উৎপন্ন করার দিক দিয়ে কানাডা বিশ্বের শীর্ষেই অবস্থান করছে। কিন্ত অন্যান্য তেলের আমদানি কমে যাওয়ায় ক্যানোলার আভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন বেড়েছে, এর রফতানি মূল্যও তেমন বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে সাধারণ কানাডিয়ানদের জীবনে। একটু আগে কথা বলছিলাম সিনিয়র বন্ধু ড. ইলিয়াস মাহমুদের সঙ্গে। তিনি লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন থেকে জনস্বাস্থ্যে পিএইচডি করে এখন সৌদি আরবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। ভাবি চাকরির সুবাদে লন্ডনে গেছেন বিধায় রোজার ঈদ তিনি স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে লন্ডনে করেছেন। কথায় কথায় বললেন ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব খুব বাজেভাবে পড়েছে লন্ডনের বাজারেও। সুপারস্টোরগুলোতে ভোজ্যতেলের হাহাকার। পাওয়া গেলেও ছোট ছোট বোতলে অনেক দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও লিখে দেয়া হয়েছে পরিবারপ্রতি এক লিটারের বেশি তেল কেনা যাবে না। লন্ডনের মতো টরেন্টোর বাজারেও দাম বেড়েছে কলা, দুধ, পাউরুটি, ডিমসহ সবকিছুর দাম। এদিকে সুইডেন ও ডেনমার্ক যদি ন্যাটোয় যোগ দেয় তাহলে এই সংঘাত কোন্দিকে মোড় নেবে সে বিষয়ে চিন্তিত ইলিয়াস ভাই। স্ত্রী সন্তানের কাছে নিজে চলে যাবেন, না তাদের আবার ফিরিয়ে আনবেন নিজের কাছে সৌদি আরবে তা পুরোপুরি নির্ভর করছে সুইডেন-ডেনমার্ক ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কী হয় তার ওপর। হাজার মাইল দূরের যুক্তরাষ্ট্রের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট তার দেশকে আজ যে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তার মাশুল গুনছে সমগ্র বিশ্ব। আপনি পশ্চিমা বিশ্বের চালানকৃত ফুটেজ দেখে যতই গোঁফে তা দিতে থাকুন এই ভেবে যে, রাশিয়ার আর্মি ক্লান্ত পরাস্ত, আদতে তা সর্বৈব মিথ্যা। সোনার ইউক্রেন আজ মাটিতে মিশে গেছে। সিরিয়ার সঙ্গে তার ভৌগোলিক চেহারার পার্থক্য অনেক জায়গাতেই নেই। বিশ্বকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি কিন্তু ওই যুক্তরাষ্ট্র। আগে নিজেরাই যুদ্ধে অংশ নিয়ে ভরাডুবির সম্মুখীন হয়ে এখন বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তারা দূর থেকে মজা নিচ্ছে– পুঁজিবাদের এই মর্মান্তিক পরিক্রমা কেউ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই শিখুক! সারাবিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি তুঙ্গে, দ্রব্যমূল্য ভারসাম্য হারাচ্ছে, মানুষের আয় কমবে, ব্যয় বাড়বে, অর্থনৈতিকভাবে আক্রান্ত হলে মানুষ সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে, বিশ্ব অশান্ত হয়ে যায়। সারাবিশ্বে খুব করে শান্তির নিদর্শন খুঁজে বেড়াচ্ছি। গাড়ির তেলের খরচ কমাতে বাংলাপাড়ায় গিয়ে প্রিয় শিঙাড়া খাওয়া কমিয়ে দিলেও মানিব্যাগের হাহাকার নজর এড়াচ্ছে না ইদানীং। আমার কাছে আজ এই বিবর্ণ দুপুরে বিশ্বের জন্য কোন সুখবর নেই। আপনার কাছে থাকলে দু’কলম লিখে আমাকে একটা চিঠি দেবেন প্লিজ। ১৬ মে ২০২২ টরেন্টো, কানাডা
×