ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

আনা ফ্রাঙ্কের বিশ্বাসঘাতক

প্রকাশিত: ২১:৩৭, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

আনা ফ্রাঙ্কের বিশ্বাসঘাতক

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চলতে থাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসের এক লোমহর্ষক ঘটনাপঞ্জি। মানবতার চরম স্খলনে বিশ্ব কাঁপানো দুর্ধর্ষ হিটলারের ইহুদী নিধন করুণ আখ্যান কালের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো নয়। জার্মানিতে ঘটে যাওয়া বীভৎস কাহিনীর বিবর্ণ সময়গুলো কিভাবে অতিক্রম করা হতো তা জানার উপায় সেভাবে ছিলও না। তবে জার্মানির এক উদ্দীপ্ত কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক তেমন নৃশংস আঁচড়ের কালো অধ্যায়কে লিপিবদ্ধ করেছেন প্রতিদিনের দুঃসহ কাহিনীর মধ্যে। আনার বয়স তখন খুব বেশি নয়। বালিকা থেকে কিশোরী অনুভবের পরম সন্ধিক্ষণ। বিধ্বংসী, যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ভাবার কথাই নয়। স্বপ্নের জাল বুনে আগামীর জার্মানির আকাক্সিক্ষত জগত দেখার তাড়নায় আপ্লুত হওয়ার প্রত্যাশা। কিন্তু হিটলারের নাৎসি বাহিনী সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে শুধু জার্মানি নয়, সারা বিশ্বকে আগুনের লেলিহান শিখায় নিশ্চিহ্ন করতে মহাসমরে লিপ্ত। ১৯২৯ সালের ১২ জুন জন্ম নেয়া আনা ১৯৪২ সালে ১৩ বছরের এক সম্ভাবনাময় তরুণী। ইহুদীদের বিপক্ষে মারণাস্ত্র খাঁড়া করে তাদের পিষে মারার অনভিপ্রেত ঘটনা ছিল জার্মান অধিবাসী ইহুদীদের জন্য মর্মান্তিক। জগত জোড়া শাসন কায়েমের দুরভিসন্ধি মাথায় চাপল ঘাতক হিটলারের। ভীতসন্ত্রস্ত জার্মান নাগরিক যারা ইহুদী ধর্মে জীবনাচরণে উৎসর্গিত তাদের পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া কোন গত্যন্তরও ছিল না। পিতা অটো ফ্রাঙ্কও সপরিবারে হল্যান্ড চলে গেলেন ১৯৩৩ সালে। যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল আরও পরে। তবে ভেতরে তার পূর্ব প্রস্তুতি চলছিল কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু হল্যান্ডও খুব বেশি দিন নিরাপদ ছিল না। ১৯৪১ সালে হিটলারের দখলদার বাহিনী হল্যান্ডকে তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসল। আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার পুনরায় বিপর্যস্ত এবং হতোদ্যম। হল্যা-ের নির্মল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আনা ফ্রাঙ্ক এক সময় অনুভব করলেন- তারা আর আগের মতো নিরাপদে নেই। নাৎসি শিবির থেকে ডাক আসতে লাগল আনা পরিবারের। কিন্তু তেমন সময়েও নির্বিকার অটো ফ্রাঙ্ক। এভাবে আরও দুটো বছর কেটে গেল ভয়ে, শঙ্কায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। কিন্তু ১৯৪৪ সালে তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গায় নাৎসি বাহিনীর অপ্রত্যাশিত আক্রমণ ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই থাকল। তবে সে লুকানো ঘটনার নেপথ্য নায়কের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পৃথিবীকে আরও ৭৭ বছর অপেক্ষায় থাকতে হলো। আনা ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারের গোপন তথ্য ফাঁস করার ইতিবৃত্ত বিশ্ব অবাক চোখে উপলব্ধি করল। যিনি তাদের ধরিয়ে দিলেন- তিনিও নাকি ইহুদী। নিজ পরিবারকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে আনার পারিবারিক নির্মল আবহকে নৃশংস আঁচড় বসিয়ে দিতে ভাবলেন না মোটেও। বিশ্বাসঘাতকতার এমন ন্যক্কারজনক করুণ আখ্যান যেন মেনে নেয়া যায় না। সম্প্রতি এক তদন্তে বেরিয়ে আসল ১৯৪৪ সালে নাৎসি বাহিনীর হাতে কিভাবে অটো ফ্রাঙ্কের পরিবার জিম্মি হয়ে গেল। আর ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে আনা ও তার মায়ের মৃত্যুর খবর বন্দী শিবির থেকে জানা যায়। আনার বয়স মাত্র ১৬ বছর পূর্ণ হতে আরও ৩ মাস বাকি ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তদন্ত সংস্থা এফবিআই দাবি করে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের অধিবাসী ইহুদী আরনল্ড ভ্যানডেন বার্গ আনা ও তার পরিবারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কয়েক ইতিহাসবেত্তা এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মিলে টানা ছয় বছর গবেষণা করে এমন চাপা পড়ে যাওয়া রহস্যের উদ্ঘাটন করেন। ভ্যানডেন বার্গ সেই সময় আমস্টারডামের ইহুদী কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৪৩ সালে কাউন্সিল বাতিল করে অনেককেই কারাগারে পাঠানো হয়। তার মধ্যে কিন্তু ভ্যানডেন ছিলেন না। শুধু তাই নয়, স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে তাকে দিন কাটাতেও দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন নাৎসিদের কাছে কিছু তথ্য ফাঁস করার বিনিময়ে তিনি একটি শান্তির জীবন পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয় এই তথ্য পাচারের ঘটনাটি অটো ফ্রাঙ্ক নিজে জানলেও গোপন করে যান। আর আনা ফ্রাঙ্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা ডায়েরি সারা পৃথিবীর কাছে এক অনন্য জিঘাংসার দলিল। নাৎসি বন্দী শিবিরে নৃশংস হত্যাকা-ের আগ পর্যন্ত আনা নিয়মিত তার প্রতিদিনের লিপি লেখা বন্ধ করেননি। নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জার্মানিতে হিটলারের ইহুদী নিধন অভিযান এক কুখ্যাত সমর নায়কের উন্মত্ত আস্ফালন তো বটেই। যা আজও দুনিয়াজোড়া এক জঘন্য পৈশাচিকতার নির্মম ঘটনা পরম্পরা। আনা ফ্রাঙ্কের দিনলিপি সেই দুঃসময়ের এক দুঃসাহসিক আত্মকথন। তিনি ডায়েরির কথক অত্যন্ত সাবলীলভাবে যেন শৈল্পিক আঁচড়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। আমরা এখন সেই দিনলিপির ঘটনা পরম্পরাকে নিয়ে এসে তৎকালীন সময়ের বিধ্বংসী জিঘাংসাকে উপস্থাপন করব। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান পিতা অটো ফ্রাঙ্ক। আর আনাদের দুই অকৃত্রিম সুহৃদ এলি আর মিপ অটোর হাতে তুলে দেন লাল মলাটের এক ঐতিহাসিক মর্মান্তিক আলেখ্য। তার দিনলিপিটা শুরু করা হয় ১৯৪২ সালের ১৪ জুন থেকে। যখন তারা জার্মান থেকে পালিয়ে হল্যান্ড গেলেন। আর হল্যান্ড যখন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অধীনস্থ হলো তখনই ডাক পড়ল বন্দী শিবিরে অটো ফ্রাঙ্কের পরিবারের। কিন্তু আনা পরিবার বন্দী শিবিরে ধরা না দিয়ে গোপন আস্তানায় নিজেদের আড়াল করে রাখল। আনা তখন ১৩ বছরের এক ফুটন্ত কিশোরী। সেই থেকে বিপন্ন সময়ের দিনলিপি শুরু হয় যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলমান ছিল। ১৯৪২ থেকে ’৪৫। কেমন ছিল সে সময়ের উন্মত্ত জার্মানি আর উদ্ধত বিশ্ব? ২৫টা মাস কাটিয়ে দিলেন গোপন আস্তানার নিভৃত আঙিনায়। আর লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন নাৎসি বাহিনীর চরম অরাজকতা এবং ইহুদী নির্মূলের বিধ্বংসী করুণ আখ্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরম ভয়াবহতার কাহিনী বিধৃত হয়। একইভাবে নিজেদের যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যিক ঘটনাবলির সঙ্গে বোমা বর্ষণের হৃদয় কাঁপানো ঘটনাও উঠে আসে যা এক ১৫ বছরের তরুণীকে নানামাত্রিকে উৎসাহিতই শুধু নয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায়ও দিন যাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। ডায়েরিতে ছোটখাটো পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠানের কথাও চমৎকার ভাষায় বর্ণিত আছে। যেমন বাবার জন্মদিন, বাবা-মায়ের বিয়ের ১৯ বছর উদযাপন। বাবার জন্য উপহার সামগ্রীও ডায়েরির লেখা থেকে বাদ যায়নি, গোপন এলাকার হদিস না পেলেও নাৎসি বাহিনীর আক্রমণাত্মক উন্মাদনা সারা বিশ্বকে যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা অনুমান করতে পারা যেত। তবে জার্মান ছেড়ে ইউরোপের হল্যান্ড কিংবা ইংল্যান্ড কোন রাষ্ট্রই যে তাদের জন্য নিরাপদ নয় তা অনুধাবন করতে কষ্ট হয়নি কখনও। নিজের দেশের লোকসান কিংবা লোকবল হারানো ইংল্যান্ড কিংবা হল্যান্ডের পক্ষে কঠিন কাজ। সেটা তারা করবেও না। কিন্তু ইহুদীদেরও তো বাঁচতে হবে নিজেদের মান-সম্মান আর ধর্মকে সুরক্ষিত রেখে। আর সেটাই ছিল সে সময়ের সবচেয়ে চরম দুর্দশা। হল্যান্ডের যেখানে গোপন আশ্রয়ে তারা ছিল সেখানেও প্রতিদিন ইহুদীদের পাকড়াও করে বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়ার দুর্ভোগও সহ্য করতে হয়েছে। সারা বিশ্ব হতচকিত। পৃথিবীময় চলছে এক চরম অব্যবস্থাপনা। শুধু ইহুদী চিহ্নিত হলেই চরম সর্বনাশ আসতে সময় লাগছে না। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি থেকেই উদ্ধৃত করছি- ‘সারা পৃথিবীটাই ওলট-পালট হয়ে গেছে। শ্র্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের পাঠানো হচ্ছে বন্দী শিবিরে, জেল খানায়, নির্জন কুঠুরিতে, আর যারা নিচ তারা জাঁকিয়ে বসে ছেলে-বুড়ো, ধনী-দরিদ্র সকলের মাথায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে। কারও যদি ফাঁদে পা পড়ে কালোবাজারে গিয়ে, তা হলে আর একজন পা ফসকাচ্ছে অজ্ঞাতবাসে থাকা ইহুদীদের সাহায্য করতে গিয়ে। নাৎসিদের দলে নাম না লেখালে কার বরাতে যে কি ঘটবে তা কেউ বলতে পারে না।’ কি চরম সর্বনাশা প্রতিদিনের যাপিত জীবন। আনা ফ্রাঙ্ক সুললিত ভাষায় তার মননসত্তাকে উন্মোচন করলেও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আর্তি অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটেও ওঠে। হল্যান্ডকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসার অভিব্যক্তিও আনাকে তাড়িত করে। স্বদেশ ছেড়ে আসার করুণ আর্তনাদ ভেতরের বোধে জিইয়ে থাকে। তার পরও মাতৃভূমির মর্যাদায় হল্যান্ডকে ঘিরে থাকার প্রত্যয়ও উদ্দীপ্ত হতে সময় লাগে না। পাশের এক ইহুদী সবজিওয়ালাকে নাৎসি বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। সে আর ফিরে আসেনি। পরিস্থিতির প্রচ- চাপে তাদের প্রতিদিনের আহার জোগাড় করাও এক দুর্ভোগ। মাঝে মধ্যে খাবার কমে যাওয়া এমন কি প্রাতঃরাশ বন্ধ হওয়ার উৎক্রমও লেখনিতে উঠে আসে। একদিকে কুখ্যাত হিটলারের জঘন্য বাহিনী পাশাপাশি ইহুদীদের নিত্য জীবনের করুণ আখ্যান আনা ফ্রাঙ্ককে যে মাত্রায় অসহনীয় করে তোলে তাও আত্মকথনের নিদারুণ মর্মবেদনা। প্রতিদিনের অন্নসংস্থানও ইহুদীদের জন্য এক বিপজ্জনক দুরবস্থা। যা নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার চেয়েও কম উদ্বেগজনক নয়। এমন অসহনীয় পরিস্থিতিতে আনা যে কিভাবে তার দিনলিপি সম্পন্ন করলেন সত্যিই অবাক হওয়ার ব্যাপার। তাও আবার এক সম্ভাবনাময় তরুণীর নিজের জবানীতে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপে নাৎসি বাহিনীর অপশক্তি আর কর্মকে কলমের তীব্র আঁচড়ে শাণিত করা। প্রতিদিনের গোসল, প্রয়োজনীয় কাজে পানির ব্যবহার, রান্না-বান্নার আয়োজন ছাড়াও খাবার পরিবেশন এক অবরুদ্ধতার জালে আটকানো। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোন শুভযোগ নেই। বরং অশনি সঙ্কেতে প্রত্যেকের জীবন এবং গতি যেন নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দুরবস্থা। এক সঙ্গে বসবাস করা অনেকেই নিত্য ঝামেলা এবং খুনসুটি লেগেই থাকে। সারা ইউরোপে আক্রমণাত্মক ঘটনাপ্রবাহ প্রতি মুহূর্তে বেতারে জানানো হচ্ছে। গোপন জায়গায় সাংঘাতিক উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। হয় মুক্তি না হয় চিরবন্দিত্ব বা মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া। এমন আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে জীবন কাটানো যে কত ভয়াবহ এবং অনিশ্চিত তা একজন কিশোরীর লেখনিতে যে মাত্রায় উদ্ভাসিত মনে হয় যেন একজন পরিপক্ব মননসত্তার সচেতন দায়বদ্ধতা। কৈশোরের অবোধ ছেলে মানুষির জালে আটকা পড়া তো নয়ই। ভাবাই যায় না চরম দুর্বিপাকে পড়া এক তরুণী কি মাত্রায় দুঃসাহসিক মনোসংযোগে তার প্রতিদিনের রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেছেন সুসংহত শক্তিময়তায়। আনার একটি অসাধারণ উক্তি উল্লেখ করতে চাই- ‘এটা এখন আর শুধু ইহুদীদের ব্যাপার থাকছে না, এর সঙ্গে আজ গোটা হল্যান্ড আর তামাম ইউরোপও জড়িয়ে পড়ছে।’ আবার আশা জাগানিয়া অনুভবে ভাবছে- তারা পুনরায় নতুন করে স্কুলে যেতে পারবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এমন নৃশংস ঘটনার বর্ণনা যাকে হতবাক করেছে- সেখানে বন্দী হওয়ার পর আনার অসহনীয় জীবনও কখনও স্বস্তিতে কাটেনি। বোনের মৃত্যু সহ্য করতে না পারায় আনা অতিসত্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। লেখক : সাংবাদিক
×