জাতির সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালীর রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু, ২৪ বছরের স্থির-প্রতিজ্ঞ সাধনায় এমন এক ঐশী-সুর বংশীতে ধারণ করেছিলেন, সমগ্র জাতি হারিয়ে ফেলা ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়ের আলোক-সন্ধানে ‘মর্মবেদনাঘন অন্ধকার’ থেকে ক্ষিপ্র প্লাবনধারা হয়ে ছুটে এলো। গত শতাব্দীর ’৪৮ থেকে ৫২, ৫৪, ৫৮, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১। দৃশ্যক্রমদক্ষনটের মতো সুবিন্যস্ত করে, প্রখর মেধাবী চেতনার পেন্সিলে যেন পূর্বেই অঙ্কন করে রেখেছিলেন চড়াই-উৎরাইয়ের এ পথরেখা। আত্মচৈতন্য ও অতিন্দ্রীয় সামর্থ্যকে সূর্য লোকের কোন দীপ্তিতে নিয়ে গেলে অনেক দূরের সত্য সে স্পষ্ট দেখতে পায়! মুজিবের মতো প্রজ্ঞাবান, পরিণামদর্শী, স্থিতধী রাজনীতিক, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছর পরের নৃশংস নিষ্ঠুরতার সত্যচিত্র দেখতে পাননি? বিখ্যাতজন-সম্মোহনী চশমার বহুদর্শী লেন্সে বীভৎস ঘাতকদের অপছায়া অবশ্যই দেখেছেন। কিন্তু ঘাতক-ছায়ার সঙ্গেই তো ‘পরাভব না মানা উঁচু শিরে’ মৃত্যু-ফাঁদের গিরিপথ পাড়ি দিয়ে, পরম বিধাতা এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণ, তিন লক্ষ মা-বোনের আব্রু কেড়ে নিয়েও হায়েনার দল তাঁর স্বপ্নের মহিমা মুছে দিতে পারেনি। স্বাধীন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি পবিত্র ভূমি তাঁর জন্য নিরাপদ না হলে, এ জীবন তুচ্ছ। গোয়েন্দা-বার্তা, বিদেশী মিশনের সতর্কতা কিছুই টলাতে পারেনি অকুতোভয় চিত্তকে। হত্যাকা-ের পর মুরুব্বি ইন্ধনদাতা, কিস্তি টুপি পরা খ. মোশতাককে মজাদার ক্ষমতার সার্কাস-আবেষ্টনীতে নিয়ে এলো ঘাতকরা। দক্ষ জোকারের ক্রীড়ানৈপুণ্য-নৃত্যে দর্শক মাতিয়ে, মসনদে-আলার তখতে বসে পড়লেন তিনি। মুজিবের প্রাণহীন তাজা লাশ তখনও ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে। রাজনৈতিক ইন্ধনদাতাকে দক্ষিণা প্রদানের তিন দিন পরই সামরিক পোশাকের মদদদাতা জেঃ জিয়াকে সেনাপ্রধানের নৈবেদ্যে অভিষিক্ত করা হলো। দু’জনই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের আপন সদস্য-মর্যাদার উষ্ণ সান্নিধ্য পেয়ে আসছিলেন। নির্মম পরিহাস, মুজিব উৎখাতে জড়িতদের বিশ্বের বিবেকবান মানুষ যখন ‘বেজন্মা’ বলে থুতু দিচ্ছিল, তখন দুই ইন্ধনদাতাই খুনীদের সূর্যসন্তান আখ্যা দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিতে যাবতীয় বন্দোবস্ত করেন। একজন ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে, আরেকজন আরও পোক্ত করে পার্লামেন্টে আইনের মোড়ক লাগিয়ে।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জননেতা হিসেবে উত্থান পর্ব থেকে মুজিবকে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব-বিদ্বেষী, ইসলামের দুশমন বলে লেভেল এঁটেও পাকিস্তানী শাসকরা সুবিধা করতে পারেনি। বরং নিজের রাজনৈতিক মনীষায় পাকিদের পাক দিলে মোচড় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মূলধন শ্যামল পূর্ব-বাংলার অতি-সরল জনগণ। বাঙালীর আত্ম অধিকার, ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিতে, আন্দোলনে মুজিব প্রয়োগ করলেন নিজস্ব উদ্ভাবনা আর বিচক্ষণতায় শান দেয়া প্রজ্ঞা প্রসূত সত্য-দর্শন। তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচে প্রতিভাত অনেক দূরের পবিত্র সুবর্ণ-দ্যুতি। পটভূমি নির্মাণের ভিতে মুজিব সেই ৪৮ সাল থেকে একক ক্ষমতায় ইস্টকখন্ড গেঁথে আসছেন! স্বাধীনতায় প্রায় বীতস্পৃহ একটি জাতিকে মুজিব তাঁর বিশাল বাঙালী-হৃদয়ের নির্যাস ঢেলে, পরম ভালবাসায় অমল করতলে আকাশ ছুঁয়ে ডাকলেন-‘ভায়েরা আমার’। একটি জাতি আপন মানুষের এমন মায়াভরা দরদি-ডাক শুনে অপার মুগ্ধতায় হাত না তুলে পারেনি।
সত্যের সঙ্গে যখন মিথ্যের মিশেল হয়, সত্য নিভৃতে লুকিয়ে কাঁদে। জারি থাকে মিথ্যার সীমালঙ্ঘন আস্ফালন। জেঃ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক উপাধিতে স্বাধীনতার অগ্রদূত বানানোর নানা কসরত হয়েছে। জীবদ্দশায় জিয়া নিজেও যে দুঃসাহস দেখাননি। এ অপ-নৃত্যের নর্তন শালায় কারা অতি-তৎপর কুশীলব তীক্ষè তাকালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কালুরঘাট ট্রান্সমিটার স্টুডিওতে যদি জিয়াকে খুঁজে না আনা হতো, ঘোষণাটিতে জিয়ার স্বর ব্যবহার না হতো, তা হলে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ কি বন্ধ হয়ে যেত? মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রজ্বলিত স্বর্ণদ্যুতির আদৌ।
নির্দিষ্ট করে ব্যক্ত করা অসমীচীন নয় যে, নিয়মিত ও গেরিলা সেনাসংখ্যায় সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল কে ফোর্স। খালেদ মোশাররফের অনবদ্য নেতৃত্বে ক্র্যাক প্লাটুনের নগর গেরিলারা ঢাকা শহরের উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোকে নিশানা করে যে বিস্ময়কর পরাক্রম প্রদর্শন করেছিল, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে সারা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল। বিশ্বজনমত গঠনে, সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকে সাহসী গতিশীল ইতিবাচক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম খালেদের অভূতপূর্ব যুদ্ধকৌশলের অবদান অপরিসীম। উপরন্তু ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ গর্জনের পর বাঙালী সেনাকর্তাদের সংগঠিত ও যোগাযোগ স্থাপনের সাহসী প্রয়াস ও কৃতিত্ব ছিল তাঁর। নিয়তির পরিহাস, ’৭৫-এর আগস্টে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকা-ের পর শুরু হওয়া অমানিশার নিষ্ঠুর খেলায় খালেদ হলেন পরাজিত খলনায়ক।
স্বাধীনতার জন্য তীরহারা প্রলয়-ঢেউয়ের যে মহাসাগর পাড়ি দিতে হয়েছে, মেঃ জিয়ার ঘোষণা-পাঠ, সেই মহাসাগরের লক্ষ কোটি বিপুল তরঙ্গের অজস্র লক্ষণীয় বুদ্বুদের মাঝে সূচনা লগ্নের একটি বুদ্বুদ সাত মহাসাগর পাড়ির মহান দিশারি, কাণ্ডারী মুজিব। মহাকাব্যের সর্বাঙ্গ-সমগ্র রচনা করেছিলেন কালান্তর জয়ী মহাকবি মুজিব। বৃক্ষকে বৃক্ষ আর তৃণকে তৃণ বলাই ন্যায়সঙ্গত। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হলেও ছলে কৌশলে কিছুক্ষণ বড় বানানোর ক্রীড়া-কৌতুকে তালিয়া জোটে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বড় হওয়া যায় না।
মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পটভূমি, জাতির জনকের বহুদর্শী কৌশলের সত্য রহস্য, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসী গেরিলা প্রতিরোধ যুদ্ধ, রাজধানীতে ক্র্যাক প্লাটুনের নগর গেরিলাদের অকুতোভয়, রোমহষর্ক জীবন বাজি এ্যাডভেঞ্চার। শহীদ জায়া-জননীদের অবিশ্বাস্য আত্মত্যাগ, আর্তি, যাতনা। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচার নিধনযজ্ঞ। বাঙালী কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর, শান্তিবাহিনীর অপতৎপরতা। অবরুদ্ধ দেশবাসীর দুর্দশা, হতাশা ও ভরসার চিত্র। ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণ, তিন লক্ষ মা-বোনের আব্রুর বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, তার সমগ্র ইতিহাস বিশদভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। আত্মপরিচয়ের গৌরবময় প্রতিটি অধ্যায়কে সহজ উৎসাহ- যোগানিয়া বর্ণনা, ভাষায় শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় বছরব্যাপী বিভিন্নমুখী আয়োজনের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতার সত্যপাঠ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। এ শুভ-উদ্যোগের সঙ্গে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা এবং সংস্কৃতিকর্মীদের সংযুক্ত করা যেতে পারে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দার্শনিক ধারা, স্থপতি-দ্রষ্টা, জনক মুজিবের স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক উন্নত জাতি ও দেশ গড়ার বিপক্ষে একদল গিবত, কুৎসাকারী কাওয়াল তবু থাকবে। নিঃশঙ্ক পর্বতের পাদভূমে এক দঙ্গল মূষিকের খোঁড়ল-কীর্তনে কি অকুতোভয় অপ্রতিরোধ্য শেরপার অদম্য অভিযাত্রীদের অগ্রযাত্রা থেমে যেতে পারে কখনও?
লেখক : কথাকার, প্রকৌশলী (অব)-বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড