ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুনা তাসমিনা

নাজমুন নাহার ॥ ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক

প্রকাশিত: ০০:০৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

নাজমুন নাহার ॥ ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক

প্রতিটি মানুষের জীবনে স্বপ্ন থাকে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন কেউ করতে পারেন, কেউ পারেন না। অনেকেই আবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নিয়ে এগিয়ে যান তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে পূরণ করার লক্ষ্যে। আজ আমরা তেমন একজন সফল মানুষের কথাই জানব। তিনি নাজমুল নাহার। প্রত্যেক সফল মানুষের জীবনে কেউ না কেউ থাকেন, যাঁদের অনুপ্রেরণা তাঁকে সফলতা এনে দেয়। নাজমুন নাহারকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দিতেন তাঁর বাবা। তাঁর দাদা আহমদ উল্লাহ ১৯১৬ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আরবের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। বাবার মুখে শোনা দাদার জীবন কাহিনী শিশু বয়সেই নাজমুন নাহারের মনে গেঁথে গিয়েছিল। বিভিন্ন দেশের ভ্রমণকাহিনী নাজমুন পড়তেন ছোটোবেলা থেকেই। করতেন ম্যাপের উপর গবেষণা। পৃথিবী ভ্রমণের স্বপ্ন এভাবেই তাঁর মনে স্থান করে নেয়। নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণের সূচনা ২০০০ সালে। ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এ্যাডভেঞ্চার’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তাঁর বিশ্ব ভ্রমণ শুরু। সেখানে তিনি প্রথম ৮০ দেশের ছেলেমেয়ের সামনে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেন। ভ্রমণ খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু যাঁর লক্ষ্য অটুট, তাঁর বিজয় নিশ্চিত। ২০০৬ সালে নাজমুন পড়াশোনার জন্য চলে যান সুইডেন। পড়াশোনার পাশাপাশি করতেন খ-কালীন কাজ। সামারে তিনি ১৭-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে টাকা জমাতেন শুধু ভ্রমণে খরচ করার জন্য। কম খরচে থাকতেন পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে। কখনো তাঁবু করে, কখনও কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে তিনি খরচে স্বল্পতা আনতেন। কোন দেশ ভ্রমণের পূর্বে তিনি সেই দেশের ম্যাপ ও সেখানকার দর্শনীয় স্থান নিয়ে গবেষণা করতেন। বের করে নিতেন কীভাবে কম খরচে সেখানে পৌঁছানো যায়। ১ জুন ২০১৮ সালে ১০০তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন জাম্বিয়া ও জিম্বাইবুয়ে সীমান্তের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের উপর। বিশ্ব ভ্রমণে নাজমুনের চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। সেই চ্যালেঞ্জগুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে নাজমুন বলেনÑ ‘বিশ্ব ভ্রমণের সময় মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসেছি বহুবার। মধ্যরাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছি। সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ের মধ্যে পড়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি। পোকা মাকড়ের কামড় খেয়েছি। অন্ধকারে অচেনা শহরে, আফ্রিকার জংলী শহরে পথ হারিয়েছি। তিন মাস আফ্রিকাতে আলু খেয়ে ছিলাম। কখনও না খেয়ে থেকেছি। কখনও কাঠ, কখনও পাথরের ওপর ঘুমিয়েছি। কখনও আদিবাসীদের সঙ্গে মাটির ঘরে ঘুমিয়েছি। কখনও রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে। ১৪২০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর রেইনবো মাউনটেইনে অভিযাত্রায় আন্টিচুডের সমস্যার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। মৃত্যুকে জয় করে সেই পর্বতশৃঙ্গে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সমুদ্রের তলদেশে স্কুবা ডাইভিংয়ের সময় পাইপ লিক হয়ে লবণাক্ত পানি খেয়েও বেঁচে ফিরেছি। পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ৩টার সময় আটকা পড়েছিলাম। সেসময় ২৬ ঘণ্টা অনাহারে থেকেছি। আদিবাসীদের সঙ্গে কাটানো সেই লোমহর্ষক ঘটনা মনে পড়লে আজও শিহরে উঠি। কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত আরোহন করে নামার সময় পড়ে গিয়ে ছোট্ট একটি বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম। পড়ে গেলে হয়তো সেদিনই মৃত্যু হতো। গাছে ঝুলে থাকা আমাকে আয়মেরিক ও জুলিয়ান নামক দুজন অভিযাত্রী বাঁচিয়েছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু সবই মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করেছি। সিয়েরালিওন থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাস্তা কোথায় ভয়ঙ্কর উঁচু, খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল। কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল সরিয়ে চলতে হয়েছিল। বিপদসঙ্কুল ওই জায়গাগুলোতে কোন না কোন হৃদয়বান ব্যক্তি সাহায্য করেছেন। পথ দেখিয়েছেন। যখনই কোন সমস্যায় পড়েছি, কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন শহরে লোকাল ফ্যামিলির সঙ্গে থেকেছি। বিশ্ব মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি মৌরিতানিয়ায়। সেখানে সাহারার তপ্ত মরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ধারালো বালির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার সময় তিন ঘণ্টা জঙ্গলে হেঁটেছি। সেন্ট লুইতে একাকী পথ হারিয়ে আট কিলোমিটার অন্ধকার পথ হেঁটেছি। ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। ‘সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থেকেছি। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুই দিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিছি। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা রেখেছি।’
×