ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়-২০২১ এবং সাফল্যের গৌরবগাথা

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৪ ডিসেম্বর ২০২১

বিজয়-২০২১ এবং সাফল্যের গৌরবগাথা

পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোন জাতিরাষ্ট্রে স্বাধীনতা ও বিজয় খ্যাত দুটো দিবস উদযাপন সত্যিই বিরল। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নকে অলংকৃতত করার শোকাবহ-গৌরবদীপ্ত দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে সামরিক জান্তা কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার এবং একই সঙ্গে ঢাকাসহ দেশজুড়ে নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে সৃষ্ট গণহত্যা দিবস হিসেবেও সুপ্রসিদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস বর্বর হায়েনাদের বিরুদ্ধে অভাবনীয় সাহসিকতায় ‘জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান অকুতোভয় মুক্তি যোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ে লাল সবুজের পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর শুধু বাঙালী জাতির জন্য নয়; বিশ্বপরিম-লে নিপীড়িত-নির্যাতিত-বঞ্চিত মুক্তিকামী গণমানুষের অত্যুজ্জ্বল ইতিহাসের বিস্ময়কর অধ্যায়ও বটে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর পরিপূরক-সম্পূরক ঘটনাপঞ্জির যোগসূত্র বাঙালীকে শুধু নবতর চেতনায় উজ্জ্বীবিত করেনি; বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্নপূরণে অভূতপূর্ব সাফল্য করেছে নতুন দিগন্তের উন্মোচন। বিজয় দিবস-২০২১’র প্রারম্ভেই উল্লেখযোগ্য সাফল্যের জয়ধ্বনি দেশবাসী বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত করার উদ্দেশ্যেই এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের উপস্থাপন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ষোলোই ডিসেম্বরের সঙ্গে আমাদের অনেক ব্যথা, বেদনা, আনন্দ, গৌরব এবং আশা-আকাক্সক্ষা জড়িত। এই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানী শত্রু আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আরও শক্তিশালী শত্রু, এই শত্রু হলো অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকারি ও দুর্নীতি। এই যুদ্ধের জয় সহজ নয়। অবিরাম এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং একটি সুখী, সুন্দর, অভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই হবে আপনাদের সংগ্রাম সফল, আপনাদের শেখ মুজিবের স্বপ্ন ও সাধনার সমাপ্তি।’ আমরা সম্যক অবগত আছি যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বহুবার তিনি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন করলেও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কঠিন নতুন সংগ্রামে জয়ী হতে হবে। দৃঢ়কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর দাবি ছিল; সুখী ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণে ব্যর্থ হলে স্বাধীনতার অর্থবহতা নিদারুণ অসারে পরিণত হবে। স্বাধীনতা তখনই প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করা যাবে, যখন দেশের কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। এটি সর্বজনবিদিত যে, বাংলা নামক এই জনপদের সমাজ-ইতিহাস সুদীর্ঘ অতীত-প্রাচীনকে ধারণ করেই সামগ্রিক বিকাশ ও বিস্তার লাভ করেছে। প্রায় তিন হাজার বছরের সমৃদ্ধ পরম্পরায় এই অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থার’ অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল। ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ও পুকুর ভরা মাছ’ দিয়ে বিশেষায়িত এই অঞ্চল অনেকখানি বিশ্বখ্যাত ছিল। কিন্তু কৃষি উৎপাদনে অত্যুজ্জ্বল এই অঞ্চল দীর্ঘ সময় ব্যতিক্রম ধারায় অনগ্রসরতার পরিচয় বহন করে আসছে। এর পেছনে যে কারণটি প্রণিধানযোগ্য, তাহলো ঔপনিবেশিক তথা ভিনদেশী শাসকদের শাসন ও শোষণ এবং এই অঞ্চলের সম্পদের প্রচন্ড অমানবিক লুণ্ঠন। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বস্তুত মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলের শোষিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, দারিদ্র্যমুক্ত-ক্ষুধামুক্ত, কর্মচঞ্চল আত্মপ্রত্যয়ী, গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু নিরন্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে দীর্ঘ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যে বিষয়সমূহ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন তা ছিল পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের নির্দয় শোষণ-শাসনের নানা অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য কৃতী সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার জনাব আবুল মনসুর আহমদের মতে, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৯৪০-এ লাহোরে যা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে তা সমাপ্ত করেছেন। বিশ্বের সর্বত্রই জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং আত্মনির্ভরশীল স্বয়ম্ভর রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের অঙ্গীকার রাজনীতিক দূরদর্শিতার মধ্যেই নিহিত থাকে। ফরাসী বিপ্লবের দর্শন তথা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার যে চিরায়ত অনুপ্রেরণা, তা কিন্তু শুধু ভৌগোলিক ভূ-খন্ডের স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বহুমাত্রিকতায় তা ছিল সকল জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা জাতির পরিপূর্ণ উন্নয়নের মৌলিক উৎস প্রেরণা। ১৯৬১ সালের জরিপ অনুযায়ী- এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ, রফতানি আয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ৩০-৫০ শতাংশের বিপরীতে ৫০-৭০ শতাংশ, আমদানি ব্যয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ৫০-৭০ শতাংশের বিপরীতে ২৫-৩০ শতাংশ, বেসামরিক চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের ৮০-৮৪ শতাংশের বিপরীতে ১৬-২০ শতাংশ, সামরিক চাকরির ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বিপরীতে ১০ শতাংশ, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পুঁজি বিনিয়োগ ২.১ শতাংশের বিপরীতে পূর্ব বাংলায় ০.৬ শতাংশ। করোনা অতিমারীর দুঃসহ প্রাদুর্ভাবের সূচনাকাল থেকে অদ্যাবধি সংক্রমণ বিস্তার ও প্রাণ সংহারের দৃশ্যপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনার প্রথম-দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গের আঘাত সুচারু পরিকল্পনায় প্রতিরোধ-সাফল্য বিশ্বনন্দিত। করোনা যুদ্ধজয়ের আপতিক গৌরবগাথা দেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত করেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা-গৃহীত পদক্ষেপের যথার্থ প্রতিপালনে সামষ্টিক অর্থনীতিকে সচল রেখে দেশবাসীর জীবনপ্রবাহে গতিসঞ্চারের মহিমায় সরকারের ভূমিকা সর্বত্রই সমাদৃত হয়েছে। ভ্যাকসিন সংগ্রহ-বিতরণ ও প্রয়োগে যথাযথ ব্যবস্থাপনাও সমধিক প্রশংসিত। তাঁর সরকার কর্তৃক গৃহীত কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, পর্যাপ্ত পরীক্ষণ কিট সংগ্রহ, গণস্বাস্থ্য সংস্থাকে কিট তৈরির অনুমোদন, প্রবাসীদের প্রতি প্রশাসনের বিশেষ নজরদারী, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ, সেনা বাহিনীর সহায়তায় সংশ্লিষ্ট সুবিধার সম্প্রসারণ অবিমিশ্র সুদূরপ্রসারী বিচক্ষণতা স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা অর্থনীতির গতিশীলতা আনয়নে প্রচন্ড সহায়ক ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫০ বছরের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রায় সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিক্রমা তথা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের রোডম্যাপে অগ্রসরমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্যতার হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শ্রমঘন রফতানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উন্নয়ন, পোশাক ও ওষুধ শিল্পকে রফতানিমুখীকরণ ইত্যাদি আজ দেশের সামগ্রিক মানচিত্রে যুগান্তকারী অভিধায় সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুত, গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, গভীরসমুদ্র বন্দর, মেট্রোরেল, টানেল নির্মাণ, পরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয়-ব্যবহারযোগ্য পানি প্রকল্প ও স্যুয়ারেজ প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা-সক্ষমতা অর্জন বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃত। ৮ অক্টোবর ২০২১ গণমাধ্যম প্রতিবেদনে প্রকাশিত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২-২০২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে দেশের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা)। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২,২২৮ ডলারের বিপরীতে ২০২৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট ও গ্লোবাল হেড অব রিসার্চ বলেন, ‘যখন বিশ্বব্যাপী পুনরুদ্ধারের গতি এবং সরবরাহ অত্যন্ত অসম রয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশ ২০২০ সালে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। জোরদার টিকাদান কর্মসূচী এবং কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এলডিসি থেকে দেশের উত্তরণে প্রত্যাশিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি আরও বেড়েছে।’ যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস এ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহৎ ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। অতিসম্প্রতি সম্মানিত অর্থমন্ত্রীও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে প্রভাবশালী ২০টি দেশের তালিকায় আসছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যেসব দেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে তার মধ্যে বাংলাদেশ থাকবে। ওই সময় বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে এমন শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে রুদ্ধ করার অশুভ-অপশক্তির সকল অপচেষ্টা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে নস্যাৎ করবেই- আজকের দিনে এটিই আস্থার সুদৃঢ় উৎস হিসেবে বিবেচ্য। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×