ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম আহমেদ

টরেন্টোর চিঠি ॥ তুষারে ভোর শিশিরে সন্ধ্যা

প্রকাশিত: ২১:১৬, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

টরেন্টোর চিঠি ॥ তুষারে ভোর শিশিরে সন্ধ্যা

নব্বই দশকের শুরুতে, মাত্র প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হব হব করছি তখন, এরশাদ সরকারের পতন হলো যেই সময়টায়, ঠিক সেই সময়ে শীতপ্রধান দেশের প্রতি একধরনের তীব্র আগ্রহের জন্ম নেয় আমার। শীতপ্রধান দেশ বললে বোধহয় ঠিক হবে না, মূল আকর্ষণটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি। তাদের শাসনব্যবস্থার বৈচিত্র্য, সমাজে সাম্যব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের মিশেলে যে রাষ্ট্রযন্ত্র, তার প্রতি এক অদ্ভুত মোহ তৈরি হয়েছিল ওইসময়ে। মূলত নিকোলাই গোগল, ইভান তুর্গেনেভ, লিও তলস্তয়, ফিওদোর দস্তয়েভস্কি, আন্তম চেকভ, ম্যাক্সিম গোর্কির সাহিত্য দিয়ে রুশ স্বপ্নরাজ্যে আমার শৈশবের অলীক যাত্রা। পরবর্তীতে বাংলাদেশী লেখক মশিউল আলমের কিছু বড় গল্প ও উপন্যাস সেই ভালবাসা আরও উস্কে দেয়। মনে আছে ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম এক সময় সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে রাশিয়া যাব। সেখানে শূন্যের নিচে ত্রিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে স্যাঁতসেঁতে রাশিয়ান কোন ছাত্রাবাসে পলিটিক্যাল ইকোনমি নিয়ে তুমুল বিতর্ক করব বিদেশী সহপাঠীদের সঙ্গে। সমাজতন্ত্রকে কীভাবে যুগোপযোগী করে বিশ্বের সমস্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা যায়, সে বিষয়ে তীব্র কৌতূহল ছিল। অথচ ঠিক ওইসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলো। মিখায়েল গর্বাচেভকে মনে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খলচরিত্র। সোভিয়েত পতনে পুঁজিবাদ বিশ্বকে ভোগ-বিলাসিতায় ভাসিয়ে দেবে, সেই চিন্তা ওই সময়টাতেই বিষণœতায় ভরিয়ে দিত মন– আজও পরিষ্কার মনে আছে। ভাবনার ডানা মেলত, আবার এক নতুন বিশ্ব আসবে, সমাজতন্ত্র ফিরবে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে, বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে এত ওজনদার চিন্তা মাথায় নিতাম কিভাবে– আজ তা ভাবলে খানিকটা অবাকই লাগে। নবেম্বর ২০২১-এর এক অলস সকালে হঠাৎ নব্বই দশকের শুরুর ভাগের স্মৃতিচারণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় আসলে। আজ টরেন্টোতে এই মৌসুমের প্রথম তুষারপাত হলো। এখনও যখন লিখছি, তুষারে ঢেকে আছে শহর। রাস্তা-ঘাট অপেক্ষাকৃত নির্জন। সামনের সুউচ্চ অট্টালিকার কিছু কিছু জানালায় টিমটিমে আলোকবাতি জ্বলতে দেখা যায়। কেউ বোধহয় আমার মতোই কিছু লিখছে। এদিকে আকাশে এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য থাকে এই সময়ে। প্রচ- তুষারপাতে দূরের ভবনগুলো ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকে। পাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকে রবিবারের আনন্দ-উৎসবের শব্দ পাওয়া যায়। সস্তা এলকোহলের হাসি প্রাণবন্ত হয় বেশি, প্রাচীন মনীষীদের এই বাণীটি নিছকই মিথ্যে নয়, এটি টের পেয়েছি এই আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে থাকতে যেয়ে। তুষারপাত যখন ভারি হয়, তখন তুষারকণাগুলোকে কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে দেখা যায় খালি চোখেও। এরা দিগি¦দিক হয়ে ছুটতে থাকে খোলা আকাশে। হাওয়ায় ভেসে তাদের দৌড়াদৌড়ি দেখতে মন্দ লাগে না। তুষারকণাগুলো সরাসরি আকাশ থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে না কিন্তু। বহুক্ষণ ধরে ভাসতে থাকে, একবার ওপরে যায়, তারপর আবার নিচে নেমে আসে, কিছুক্ষণ উত্তর-দক্ষিণ করে অবশেষে যখন মাটিতে, গাছের ডালে, রাস্তায়, গাড়ির ছাদে তার ঠাঁই হয়, তখন বিদায় নেবার সময়। হয় মুহূর্তেই অন্যসব তুষার কণারা ঢেকে দেবে তাকে, অথবা কারও পায়ের নিচে কিংবা গাড়ির চাকায় জড়িয়ে গিয়ে সাঙ্গ হয় তার স্বল্পকালীন রংমেলার। যদিও তুষারপাত আজ টরেন্টোরিয়ানদের আলাপের মূল বিষয়, কিন্তু ক্যানাডিয়ান সরকার চিন্তিত করোনাভাইরাসের নতুন ধরন নিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরনটির নাম দিয়েছে ‘ওমিক্রন’। তারা জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪ নবেম্বর প্রথম ওমিক্রন চিহ্নিত করলেও বর্তমানে এতে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও বেলজিয়াম, বোতসোয়ানা, ইসরাইল, হংকংসহ, অষ্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ডেনমার্কসহ আরও কিছু দেশে। যদিও ওমিক্রন সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে বিস্তারিত তথ্য নেই, তবু এটি করোনাভাইরাসের উৎপত্তি থেকে বহুবার পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ নিয়েছে বলে তারা চিন্তিত যে, বর্তমান ভ্যাক্সিনগুলো একে কম প্রভাবিত করতে পারে। কানাডিয়ানদের সতর্ক রাখার জন্য সরকার ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বোতসোয়ানা, জিম্বাবুইয়ে, লেসোথো, এসওয়াতিনি থেকে সকল ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। যদিও কানাডার সঙ্গে এইসব দেশের কোন সরাসরি ফ্লাইট নেই, তবুও কোন কানাডিয়ান নাগরিক অথবা স্থায়ী বাসিন্দা যদি ওইসব দেশ থেকে কানাডায় আসে, তবে তাদের তৃতীয় কোন দেশে করোনা টেস্টের নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে কানাডায় প্রবেশ করতে হবে। কানাডিয়ান নাগরিক অথবা স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ ওইসব দেশ থেকে কোন অবস্থাতেই কানাডায় প্রবেশ করতে পারবে না। এদিকে ওমিক্রনের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য সবচেয়ে কড়া ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ইসরাইলে। তারা যে কোন বিদেশী নাগরিকের ইসরাইলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে ১৪ দিনের জন্য। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার যে চিকিৎসক প্রথম ওমিক্রন চিহ্নিত করেন, তিনি বলেছেন এর লক্ষণ মৃদু এবং সম্ভবত ঘরে বসেই এর চিকিৎসা করা সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার কিছু আক্রান্তদের তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে যে মূলত ভ্যাক্সিন নেননি এমন মানুষই ওমিক্রনে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তারা এই প্রাথমিক চিহ্নিতকরণের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর অন্যান্য দেশের নিষেধাজ্ঞা জারিকে অমানবিক এবং দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেছেন। ওমিক্রনই যে বর্তমানে কানাডার একমাত্র উদ্বগের বিষয় তা নয়। শীত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো কানাডাজুড়েই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। কানাডায় গতকাল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৩ জন। গত এক সপ্তাহে আক্রান্তের গড় সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮শত ২১ জন। কানাডার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ প্রদেশ অন্টারিওতে আজ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৮৫৪ জন নতুন রোগী। মারা গেছে ২ জন। বর্তমানে শুধু অন্টারিওতেই ১৫টি স্কুল বন্ধ আছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে। এদিকে কানাডায় অনেক নিয়মকানুন শিথিল করলেও নানা অফিস-আদালত এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও কার্যত অনলাইনেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জানুয়ারি থেকে সব খুলে দেবার পরিকল্পনা থাকলেও এখন করোনার এই উঠতি সংখ্যা এবং নতুন ধরন ওমিক্রনের আবির্ভাবে সামনে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা বলা মুশকিল। বারো বছরের অধিক বয়সী অন্টারিয়ানদের ৮৭ শতাংশ ভ্যাক্সিনের দুটো ডোজ নেবার পরও সংক্রমণের হার সরকারের জন্য চিন্তার বিষয় বৈকি! অন্যদিকে সম্প্রতি বন্যা, ভূমিধসে জর্জরিত প্রদেশ ব্রিটিশ কলম্বিয়ানদের দুঃখ দুর্দশা সহসা লাঘব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহ আগে হওয়া ভূমিধসে ব্রিটিশ কলম্বিয়া কানাডার অন্য প্রদেশগুলো থেকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয় যে সেখানে পৌঁছতে প্রতিবেশী দেশ যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ঘুরে যেতে হয়েছে অনেককে। এদিকে বৃষ্টি ও তুষারপাতের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট বন্যার কারণে এখন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার নতুন নতুন এলাকার মানুষকে সেখান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে সরকার। সামনের দিনগুলো এত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে নিঃসন্দেহে চোখ থাকবে বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের। অবশেষে পাতা ঝরিয়ে ঝরিয়ে তুষারের আবির্ভাব হলো টরেন্টোয়। যদিও খাতা-কলমে শীত শুরু হবে আরও মাস খানেক পরে, তবুও আকাশজোড়া তুষারের আস্তরণ আর শূন্যের দশ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচের তাপমাত্রাকে শরত বলে চালিয়ে দেয়া কানাডিয়ানদের কাম্য হলেও, বাংলাদেশীদের নয়। বাংলাদেশীদের আমার মতে, দুটো মেরুদ- থাকে। একটা শরীরে- যেটা বড় হতে হতে নানা ভাংচুরের মধ্য দিয়ে আমাদের তার উপস্থিতি নিরন্তর জানান দিতে থাকে। আরেকটি থাকে মনে, যার অস্তিত্ব প্রকট হয় কিছু মানুষের অন্তরে, আর কিছু মানুষের জীবনে থাকে নিঃসঙ্গতার মতো বিস্তৃতিহীন, গোপন। এই যে অদৃশ্য মানসপটে থাকা মেরুদ-, তার ডালপালা থাকে বটবৃক্ষের মতো। একেকটি ডালে একেকটি গল্পের বাস। কোন ডালজুড়ে দুঃখরা বাস করে তো কোন ডালে বাসা বাঁধে সুখের আলাপন। কোন ডাল থাকে পুষ্প-পল্লবে সুসজ্জিত, সেখানে কলকাকলি করে মখমলি অনুভূতিরা। আবার কোন ডাল হয় পরানশূন্য, সেখানে না থাকে আলো, না থাকে অন্ধকার। একই গাছের একই শিকড়ে বছরের পর শিল্প-বিজ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির বীজ বুনে যায় বাঙালী, তার ফল হয় বিচিত্র, অদৃশ্য মেরুদ-ের শিরদাঁড়া বেয়ে দেশপ্রেম হৃদয়ে পৌঁছায় কারও কারও। আর কারও কারও হয় রজ্জুতে সর্পভ্রম। এমন বারো রকমের মানুষ নিয়ে কানাডার মতো সুদূরে জন্মে নতুন বাংলাদেশ। সেখানে কেউ কেউ তুষারপাতের মধ্যে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকে, কেউ কেউ শিশিরের শব্দে সন্ধ্যা নামায় অজান্তে। ২৮ নবেম্বর ২০২১ টরেন্টো, কানাডা
×