ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রণেশ মৈত্র

কাজীরহাট-পাটুরিয়া রেল-সড়ক সেতু ও জাতীয় স্বার্থ

প্রকাশিত: ২১:৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২১

কাজীরহাট-পাটুরিয়া রেল-সড়ক সেতু ও জাতীয় স্বার্থ

সে অনেক দিনের কথা। ১৯৫৪ সাল। যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক নির্বাচন।হক-ভাসানী-সোহ্রাওয়ার্দী ও তরুণ জননেতা পাবনা নির্বাচনী সফরে এলে পাবনায় ও উত্তরবঙ্গের মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্থানীয় যুক্তফ্রন্টের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসভার বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে পূর্বাহ্ণে বক্তৃতা দেন শহীদ ক্যাপ্টন মনসুর আলী। নেতাদের কেউ আজ বেঁচে নেই। এটি দেশের দুর্ভাগ্য। যা হোক, সূচনা বক্তব্যে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যে দাবিগুলো তুলে ধরেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল, নগরবাড়ী-আরিচা রেল ও সড়ক সেতু। জাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগরবাড়ী-আরিচা সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকার ঐ সেতু নির্মাণের কাজে হাত দিতে পারেনি। তবে এ দাবি পরিত্যক্ত হয়নি কখনও, আজও না। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। এটি পাকিস্তান হওয়ার পরবর্তী সময়ের কথা। তখন রাজশাহী, ঈশ^রদী, দিনাজপুর, রংপুর, এমনকি যশোর-খুলনা থেকেও ট্রেনযোগে এসে সিরাজগঞ্জ ঘাটে নেমে স্টিমারে যমুনা পার হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে গিয়ে সেখান থেকে অপেক্ষমাণ ট্রেনে চড়ে বিস্তর পথ ঘুরে ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে গিয়ে নামতে হতো। পাবনা থেকে এভাবে ঢাকা যেতে ২৪-২৬ ঘণ্টা, রাজশাহী থেকে ২৭-২৮ ঘণ্টা, খুলনা থেকে প্রায় ৩০ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। এ কারণেই সকল মহল থেকে নগরবাড়ী-আরিচা ঘাটে সেতু নির্মাণর দাবি উঠেছিল। যখন নগরবাড়ী-আরিচা (ফেরি সর্ভিস চালু হলো তখন) বিশাল যমুনা বড় বড় ফেরিতে পার হয়ে ঢাকার পথে আরও দুই-তিনটা ছোট ঘাট পার হয়ে যেতে হতো। তবু ট্রেনে ঢাকা যাতায়াতের সময় ও অর্থ ব্যয় বহুলাংশে কমে এলো। তবে সমস্যা হতো অন্যত্র। স্রোতের কমবেশির কারণে নদীর অভ্যন্তরে গ্রীষ্মকালে ছোটখাটো চর-ডুবোচর সৃষ্টির ফলে বর্ষাকালের চাইতে ফেরিগুলোর নদী পার হতে অনেক বেশি সময় লাগত। তবু ট্রেনে যাতায়াতের জন্য যে দীর্ঘ সময় ও বিপুল অর্থব্যয় করতে হতো, নগরবাড়ী হয়ে ঢাকা পথে সময় ও অর্থব্যয় হতো অনেক কম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিত অন্যত্র। ফেরিগুলো সময়মতো নদী পার হতে না পারায় গ্রীষ্ম ও শীতকালে যাত্রীদের উভয় পাড়ে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে অপেক্ষা করতে হতো। যেসব হোস্টেল-রেস্তরাঁ গড়ে উঠেছিল সেগুলোতে রান্না করা মাছ, মাংস, ভাত, তরকারি আলাদা (ঢাকনা না দিয়ে বা কাচের শোকেস না করে) রাখার ফলে ধুলো-বালি-মাছি অন্যান্য পোকামাকড় ঐ খাবারগুলোর কিছু অংশ খেত বা তার ওপর দিয়ে দৌড়াত। বিশুদ্ধ খাবার জল, পায়খানা-প্রস্রাবখানা না থাকায় যাত্রীদের বিশেষ করে মহিলা যাত্রীদের, মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হতো। সরকার বা পরিবহন মালিক কেউই এদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না করায় এ কষ্ট বরাবর যাত্রীদের বহন করতে হতো এবং ঐ দূষিত খাবার খেতেও বাধ্য হতে হতো। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ত। ইতোমধ্যে রংপুরের সন্তান আলহাজ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার ব্যবহার করে ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ এলাকার সংযোগ সাধনের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ওখানে যমুনা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরশাদকে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হলো। এলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এরশাদ নির্ধারিত স্থানেই যমুনা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬তে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করে সেতুটির নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার পর সমগ্র উত্তরবঙ্গ বিপুলভাবে উপকৃত হয়। ঐ সেতু দিয়ে উত্তরে পাঁচবিবি থেকে দক্ষিণে খুলনা পর্যন্ত পণ্য ও যাত্রীবাহী হাজার হাজার ট্রাক চলাচল শুরু করে। দাবি ওঠে সেতুর ওপর দিয়ে রেলপথ বসাতে হবে। সরকারও তা চাইল। বসল রেলপথ। কিন্তু সিঙ্গেল লাইন। দুটি কারণে এই রেললাইন কার্যকর সেবা দিতে পারল না। এক- সিঙ্গেল লাইনে ট্রেনটিকে দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে অপেক্ষমাণ ট্রেনটির যাত্রী ও পণ্যের গন্তব্যে পৌঁছাতে অস্বাভাবিক বেশি সময় লাগল। দুই- এই রেললাইনে রেল চলাচলের ফলে সেতুটির ভারবহন ক্ষমতা ব্যাহত হতে থাকে। অবশ্য শুধু রেলের জন্য নয়, যেমন জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটছে তার ফলে বাস, ট্রাক, মিনিবাস, কাভার্ড ভ্যানসহ সকল প্রকার যানবাহনের সংখ্যাও প্রতিদিন বৃদ্ধি পেতে থাকায় সেতুটির সর্বোচ্চ বহনের ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় সেতুর কোন কোন স্থানে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। সকল প্রকার পরিবহন চলাচল মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ে। অথচ সেতুটির মেয়াদ ১০০ বছর বলে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিল। অবশেষে জোড়াতালি দিয়ে ফাটলগুলো বন্ধ করা হলেও ঝুঁকি দিন দিনই বাড়ছে। অপরদিকে নগরবাড়ী-আরিচা সেতু নির্মাণ সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল দিয়ে নির্মিত হওয়ায় একদম ফাঁকা হয়ে পড়ে। কারণ নদী পারাপারের জন্য এতকাল ধরে চলমান বড় বড় ফেরি প্রত্যাহার করে অপরাপর নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। নগরবাড়ী ও আরিচা ঘাট দুটির অপমৃত্যু ঘটে। দোকানপাট, হোটেল -রেস্তরাঁ, মিস্টান্ন ও ফলের দোকানসমূহ যা ঐ ঘাট দুটিকে কেন্দ্র করে রীতিমতো সরগরম থাকত, তা বন্ধ হয়ে গেল খদ্দেরের অভাবে। দুটি ঘাটই বিরান এলাকায় পরিণত হলো। কালক্রমে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু চালু হওয়ায় উত্তর-দক্ষিণবঙ্গজুড়ে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল তা ক্রমবর্ধমান যানবাহনের ভার সামলাতে সময় লাগত ২৪ ঘণ্টা। এখন দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ সময় লাগায় সেতুর উভয় পাড়ে প্রায়ই বিশাল যানজটের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা যমুনা সেতু দিয়ে মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় নতুন করে নগরবাড়ী-আরিচা সংযুক্ত করে যমুনা সেতুর অনুরূপ রেলওয়ে সেতু নির্মাণের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। নতুন করে জরিপ শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। শুরুও হয়। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনেক আগেই গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। জরিপ কাজ চলল দফায় দফায়। অপরদিকে তীব্র ভাঙ্গনের ফলে নগরবাড়ী ও আরিচাঘাট নদীগর্ভে তলিয়ে গেলে নতুন করে কাজীর হাটে স্থানান্তরিত হয় নগরবাড়ী ঘাট এবং পাটুরিয়ায় স্থানান্তরিত হয় আরিচা ঘাট। সরাসরি হতে পারছে না এই নতুন রেলপথটি সিঙ্গেল লাইন হওয়ায়। তাই পশ্চিম দিকে পাবনা- ঢাকা ডবল লাইন এবং পূর্বদিকে পাবনা-পুষ্পপাড়া, আতাইকুলা-মাধবপুর-বনগ্রাম-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ী-কাজীরহাট পর্যন্ত ডবল রেললাইন করে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় যমুনা সেতু অর্থাৎ কাজীরহাট-পাটুরিয়া সেতু নির্মাণ হলে জাতীয়ভাবে অত্যন্ত লাভজনক যাতায়াতের নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। বাস-ট্রেন প্রভৃতির জ¦ালানি খরচ বর্তমানের চাইতে অর্ধেকে নেমে আসবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয় এবং বাস-ট্রাক প্রভৃতির ভাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে। জনসংখ্যা-যানবাহন-অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দক্ষিণাঞ্চলেও বৃদ্ধি পেতে পেতে যাতে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতুর মতো সঙ্কটে না পড়তে হয়, তাই কালবিলম্ব না করে কাজীরহাট-পাটুরিয়া সেতু জাতীয় স্বার্থে নির্মাণ শুরু করা হোক অবিলম্বে। দূরদর্শী পরিকল্পনা ব্যতীত দেশ যে এগোতে পারে না তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক raneshhmaitra@gmail.
×