ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেহেদী হাসান বাবু

সবার উপরে মানুষ সত্য

প্রকাশিত: ২১:০৪, ২৭ নভেম্বর ২০২১

সবার উপরে মানুষ সত্য

বিশ্ব দরবারেও সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দেখেছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন। স্বাধীনতার পর পরই তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। যার ফল ১৯৭২ সালের সংবিধান। এটি একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ দলিল এবং রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির একটিও ছিল এই ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের ৪১ (১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোন জাতির কল্যাণ বয়ে আনে না। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় না থাকলে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতি এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধান সংশোধন করে ধর্মীয় লেবাস লাগানো হয়। যারা ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্র যদি সব সম্প্রদায়কে সমান সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে, তবেই ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হবে সম্প্রীতি, যার কথা বঙ্গবন্ধুও উল্লেখ করেছেন বার বার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হিংসা, বৈষম্য এবং নিপীড়ন নতুন নয়। কিছুকাল আগেও মোটামুটি এক সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল এই দেশে। তা বজায় রাখার একটা তীব্র স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল। সমস্যাটা হলো সেই স্পৃহাটাই এখন নেই। কেমন যেন ঠুনকো হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। যার ফলে প্রায়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার মতো ঘটনা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ঘটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে হিন্দুদের ওপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। অর্থাৎ, বছরে গড়ে প্রায় ৪৬০টি ঘটনা ঘটেছে গত আট বছরে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। প্রতিমা, পূজামন্ডপ, মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৭৮টি। এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দুধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছে ১১ জন। এর বাইরেও ২০১৪ সালে দুজন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন। শ্লীলতাহানি করা হয় আরও চারজনের। এ ছাড়া ২০১৬, ২০১৭ ও ২০২০ সালে ১০টি হিন্দু পরিবারকে জমি ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দখলের অভিযোগ ওঠে। আসকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত নয় বছরে হিন্দুদের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। এর পরবর্তী সহিংসতার শিকার হন হিন্দুরা। ৭৬১টি হিন্দু বাড়িঘর, ১৯৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ২৪৭টি মন্দির-মন্ডপে হামলা হয় ওই বছর। তখন নিহত হন একজন। সবচেয়ে কম হামলা হয়েছে ২০২০ সালে। মহামারীর মধ্যে গত বছর ১১টি বাড়ি ও ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের প্রসঙ্গটি আসছে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও উঠছে। এগুলো সাময়িক আবেগ বা উত্তেজনা। আমরা সবাই জানি এসব দাবি পূরণ হওয়ার নয়। বরং সব রাজনৈতিক নেতৃত্বই পরিষ্কার করে বলুক, তাদের ভোটের রাজনীতি, তাদের আপোসের রাজনীতি, তাদের লোভের রাজনীতির ফল সব মানুষকে আর কতকাল ভোগ করতে হবে। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের মানুষ। তাদের দুয়ারে বার বার আছড়ে পড়ছে অশান্তি। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা নিয়ে যারা ভাবেন, কাজ করেন, তারা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা। সর্বত্রই এখন হতাশা। তবে হানাহানি যারা করে তারা উজ্জীবিত। যে পরিমাণ হিংস্রতা দেখা গেল এবং যেভাবে উস্কে দেয়ার চেষ্টা দেশ-বিদেশ থেকে হচ্ছে, তাতে সভ্যতার অর্থটাই যেন বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। ফেসবুক, ইউটিউব সভ্যতার মহাসড়ক। কিন্তু এসবে বড় আকারে এখন চলছে ঘৃণার চর্চা। উস্কানি দিয়ে দিয়ে এমনভাবে মগজধোলাই করা হয়েছে যে, ধর্মের জিগির তুলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপছে না মৌলবাদী একটা জনগোষ্ঠীর। শান্তি আমাদের প্রত্যাশা, কিন্তু বাস্তবতা হলো চারদিকে শুধু ভয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের গোঁড়ামির ধাক্কায় একটা আতঙ্কের দেয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। শিক্ষিত বিবেকের এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যাকে বোঝা এবং তার সমাধানের চেষ্টা তাই এখন বিশেষভাবে জরুরী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ, সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও এখনও দেশের ভেতরে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত। বিবেকবান, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ কখনও অন্য ধর্মের পবিত্র গ্রন্থকে যেমন অবমাননা করতে পারে না, তেমনি সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা এবং পূজামন্ডপে ভাংচুরও চালাতে পারে না। কুমিল্লার পূজামন্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনীসহ অনেক জেলা-উপজেলায় অনেক মন্দিরে হামলা ও সংঘর্ষে আহত-নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা বিচার বিভাগীয় কমিটি দ্বারা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার আগে ভাবতে হবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান- আমরা সবাই একই রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। মনে রাখতে হবে একই রাষ্ট্রের নাগরিক আমরা, সবার অধিকারও সমান। চন্ডীদাস যথার্থই বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ আমাদের নবী হজরত মুহম্মদ (সা) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’ বিষয়গুলো আমরা সবাই জানলেও উপলব্ধি করি না। আসুন, সম্প্রীতির বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে আমরা নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলি যেখানে সব সম্প্রদায়, ধর্ম, জাতি ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। কোনমতেই অসাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের গৌরব বিনষ্ট হতে দেয়া যাবে না। লেখক : সাংবাদিক
×