ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ কামরুল হাসান খান

গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও শহীদ ডাঃ মিলন

প্রকাশিত: ২১:০২, ২৭ নভেম্বর ২০২১

গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও শহীদ ডাঃ মিলন

ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন ১৯৯০ সালের ২৭ নবেম্বর আনুমানিক বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ডাঃ মিলন ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বাইওকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক, তৎকালীন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ, প্রকৃচির (প্রকৌশলী- কৃষিবিদ– চিকিৎসক) কেন্দ্রীয় নেতা। ২৭ নবেম্বর ১৯৯০ দিনটি ছিল বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও চিকিৎসকদের ২৩ দফা বাস্তবায়ন আন্দোলনের এক পর্যায়ের কর্মসূচী- সারাদেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং তৎকালীন পিজি হাসপাতালের বটতলায় সকাল ১১ টায় কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশ। পাশাপাশি দেশব্যাপী চলছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের কর্মসূচী। ছাত্র সংগঠনগুলো সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃতে ঐক্যবদ্ধ । গোটা দেশ চূড়ান্ত কর্মসূচীর অপেক্ষায়। এমনি সময়ে চিকিৎসা পেশার দাবিতে বিএমএর কর্মসূচী। ডাঃ মিলন সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালের দিকে রওনা হন। পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে আরেক রিকশাতে থাকা বিএমএর তৎকালীন মহাসচিব ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। মিলন নিজের রিকশা ছেড়ে জালাল ভাইয়ের রিকশায় উঠেন। রিকশার প্যাডেলে চাপ দিতেই ডাঃ মিলন পেছন থেকে গুলিবিদ্ধ হন এবং ওখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ১৯৮৩ সালে ডাক্তার হওয়ার পর থেকে ডাঃ মিলন চিকিৎসক ও পেশাজীবীদের সকল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে নেতৃত্ব প্রদান করেন। প্রতিটি আন্দোলনে তাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে, এমনকি চাকরিচ্যুত পর্যন্ত হতে হয়েছে। যদিও চিকিৎসক পেশাজীবীদের চাপের মুখে সরকার বার বারই তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে। মিলন তাঁর কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে এদেশের চিকিৎসক, পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদদের হৃদয়ে এক মর্যাদাকর আসন অর্জন করেছিল। মিলনের সঙ্গে আমার ’৮৩ সাল থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হলেও ওর জীবনের শেষ দুটি বছর অহর্নিশি আমরা একত্রে থাকতাম। অমায়িক ব্যক্তিত্বের মানুষ মিলনের সঙ্গে ঢামেক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। আমি জয়ী হলে ওকে কোষাধ্যক্ষ পদের প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যান করেনি। দিনরাত এক সঙ্গে বিএমএ, শিক্ষক সমিতি, পেশাজীবী আন্দোলনে কাজ করেছি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য গোটা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি হুলিয়া মাথায় নিয়ে রাতে হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে দু’জনে এক সঙ্গে ঘুমিয়েছি। ডাঃ মিলন প্রগতিশীল রাজনীতির কর্মী ছিলেন এবং স্বপ্ন দেখতেন দেশে গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের। ডাঃ মিলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এদেশের চিকিৎসক সমাজ তথা বিএমএ, পেশাজীবী সমাজ জনগণের কাছে এক মর্যাদার আসন পেয়েছে। যে কারণে বিএমএর তৎকালীন সভাপতি ডাঃ এম এ মাজেদকে সর্বদলীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদান করেন। ইতোমধ্যে দেশের মেডিক্যাল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর চার দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিসহ চিকিৎসকদের সকল দাবি পূরণ করেছেন। নবীন চিকিৎসদেরও সরকারের সাধ্যমতো নিয়োগ হচ্ছে। চিকিৎসকদের রেকর্ডসংখ্যক নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন বিশ্বের দরবারে সমাদৃত, অনেক ক্ষেত্রেই ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। এখন চিকিৎসকদের গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে কেমন আছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা-পর্যালোচনা রয়েছে। সবই সঠিক তা নয়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জনগণের পূর্ণ সন্তুষ্টি পাওয়া সহজ নয়। কারণ স্বাস্থ্য বাজেটের অপ্রতুলতা, রোগীর অকল্পনীয় চাপ, দুর্বল ব্যবস্থাপনাসহ রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। তারপরেও আমাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে সর্বস্তরে। নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ কিন্তু প্রধানত চিকিৎসকদের হাতে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এদেশের চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মেডিক্যাল শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। দেশের চিকিৎসক সমাজ নানা রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএমএ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে কিন্তু মিলনের রক্ত স্নাত বিএমএতে দলমত নির্বিশেষে গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্বার্থে, চিকিৎসকদের উন্নয়ন ও অধিকারের স্বার্থে সকল চিকিৎসকের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরী। মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল বাংলাদেশে সংখ্যার দিক দিয়ে সন্তোষজনকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন সর্বস্তরে মান নিয়ন্ত্রন করা। মেডিক্যাল শিক্ষা এবং চিকিৎসায় মান নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আপোস করার কোন সুযোগ নেই। হয়ত কিছু সময় লাগবে। কিন্তু এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার। এ লক্ষ্যে নিম্নে উল্লিখিত সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট মহলের সদয় বিবেচনার আহ্বান জানাই- ১) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ : একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে অবকাঠামো এবং কর্মচারীদের দায়িত্ব পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি কাজের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং এবং ফলো আপ থাকতে হবে। ২) শেখ হাসিনা সরকার প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০০-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। ৩) স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা : জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট - কর্মচারীদের একটি দীর্ঘ মেয়াদী জনশক্তি পরিকল্পনা থাকতে হবে। ৪) জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেট : প্রয়োজনীয় বাজেট (জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ১০%) বরাদ্দ এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৫) স্বাস্থ্য খাতে কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন করতে হবে। যারা মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে দুর্নীতি করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরী। ৬) নিয়োগ ও বদলি নীতিমালা : চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিংসহ একটি গ্রহণযোগ্য বদলি-পদোন্নতি কার্যকর নীতিমালা থাকতে হবে, যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৭) মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন : স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করেছে শিক্ষা ও সেবার মান কিভাবে উন্নয়ন করা যায়। সে কারণে দেশের প্রতিটি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮) ল্যাবরেটরি সার্ভিস নীতিমালা হালনাগাদ ও জরুরী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ : সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। ৯) বিএমডিসি’কে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে। ১০) বেসরকারী কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনা : বেসরকারী খাতকে গুরুত্ব ও সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে সরকারের নীতিমালা হালনাগাদ করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আনতে হবে, যাতে নীতিমালা বাস্তবায়ন হয়। ১১) চিকিৎসক এবং সকল হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ১২) স্বাস্থ্য প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ : কেন্দ্র থেকে আর প্রশাসন গোটা দেশে নিয়ন্ত্রণ বাস্তবসম্মত নয় । তাই, গতিশীল করতে হলে বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করে প্রশাসন পুনর্বিন্যাস জরুরী। ১৩) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন : প্রশাসনকে তার আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করতে দিতে হবে। চেন অব কমান্ড কার্যকর থাকতে হবে। অন্যায় প্রভাব থেকে প্রশাসনকে মুক্ত রাখতে হবে। ১৪) মেডিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) : শক্তিশালী এমআইএস গড়ে তুলতে হবে এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ থাকতে হবে যা গবেষণা ও নীতি নির্ধারণে ব্যবহার উপযোগী হয়। ১৫) অভ্যর্থনা ও তথ্যকেন্দ্র : প্রতিটি হাসপাতালে রোগীবান্ধব অভ্যর্থনা ও তথ্যকেন্দ্র থাকতে হবে, যাতে হাসপাতালে এসে রোগীরা প্রয়োজনীয় সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে পারে। শেখ হাসিনা সরকারের প্রণীত সর্বজনগৃহীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০০ এর ওপর ভিত্তি করে সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং সংস্কারগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেই করা সম্ভব বলে দেশবাসীর দৃঢ় বিশ্বাস। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×