ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা

দণ্ড স্থগিত অথবা মওকুফ কি বলে আইন

প্রকাশিত: ২১:২১, ২৬ নভেম্বর ২০২১

দণ্ড স্থগিত অথবা মওকুফ কি বলে আইন

দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদ-প্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দী ছিলেন। করোনা মহামারী শুরু হলে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ সাজা স্থগিত করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১/১ ধারার বিধানবলে তাকে নিজ বাসভবনে অবস্থান করার সুযোগ দেয় সরকার। এক্ষেত্রে তার বয়স বিবেচনা ও মানবিক কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে শর্ত আছে যে, এ সময়ে নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে তাকে। বিদেশে যাবার কোন সুযোগ এখানে নেই। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে জানিয়ে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে অনুমতি দিতে দাবি জানানো হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এই পরিস্থিতিতে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য না ছড়িয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রথমেই আসি, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৪০১/১ ধারায়, যে ধারা প্রয়োগ এর মাধ্যমে সরকার কয়েক দফায় শর্তযুক্তভাবে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করেছে। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৪০১ ধারায় দণ্ড স্থগিত অথবা মওকুফ করার ক্ষমতা- (১) কোন ব্যক্তি কোন অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোন সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয়, সেই শর্তে তার দ- কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশ বিশেষ মওকুফ করতে পারবেন। (২) যখন কোন দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়, তখন যে আদালত উক্ত দণ্ড দিয়েছিলেন বা অনুমোদন করেছিলেন, সেই আদালতের প্রিসাইডিং জজকে সরকার উক্ত আবেদন মঞ্জুর করা উচিত কিংবা মঞ্জুর করতে অস্বীকার করা উচিত, সে সম্পর্কে তার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করতে এবং এই বিবৃতির সঙ্গে বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে, সেই নথির নকল প্রেরণ করার নির্দেশ দেবেন। (৩) যেসব শর্তে কোন দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছে, তার কোনটি পালন করা হয়নি বলে মনে করলে সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা কিংবা মওকুফ করা হয়েছিল, সে মুক্ত থাকলে যে কোন পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন এবং তার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করার জন্য তাকে জেলে প্রেরণ করা যাবে। (৪) সেই শর্তে এই ধারার অধীন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, যা যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়, সেই ব্যক্তি পূরণ করবে অথবা শর্ত এমন হবে যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে। (৪-ক) এই বিধি বা অন্য কোন আইনের কোন ধারা অনুসারে কোন ফৌজদারি আদালত কোন আদেশ দান করলে তা যদি কোন ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে অথবা তার বা তার সম্পত্তির ওপর দায় আরোপ করে, তা হলে উপর্যুক্ত উপধারাসমূহের বিধান এই আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। (৫) প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা প্রদর্শন, দণ্ড স্থগিত রাখা বা কার্যকরীকরণের বিলম্ব ঘটানো বা মওকুফ করার অধিকারে এই ধারার কোন কিছু হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করা যাবে না। (৫-ক) প্রেসিডেন্ট কোন শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা মঞ্জুর করলে উক্ত শর্ত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন, তা এই আইন অনুসারে কোন উপযুক্ত আদালতের দণ্ড দ্বারা আরোপিত শর্ত বলে গণ্য হবে এবং তদানুসারে বলবৎ যোগ্য হবে। (৬) সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলী সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারবেন। এবার আসি বিদেশ যাওয়ার প্রসঙ্গে। যে কোন নাগরিক পাসপোর্ট পেতে চাইলে তাকে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করে আবেদন করতে হবে। পাসপোর্ট প্রদান করা বা না করা সরকারে এখতিয়ারাধীন একটি বিষয়। শুধু আইনে বর্ণিত শর্তগুলো পালন করলে একজন নাগরিক পাসপোর্ট প্রাপ্তির অধিকার রাখেন। পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩-এ বলা আছে যে, পাসপোর্ট ব্যবস্থা পরিচালিত হবে ‘জনস্বার্থে’। বাংলাদেশ পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩-এর ৬ ধারা অনুযায়ী পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ যে সব কারণে কোন ব্যক্তির পাসপোর্ট বা ভ্রমণ দলিল প্রত্যাখ্যান করতে পারেন যদি সেই ব্যক্তি বাংলাদেশের কোন ফৌজদারি আদালতে বিচারাধীন কোন কার্যধারা এড়িয়ে যাচ্ছেন বা এড়াবার সম্ভাবনা আছে অথবা কোন আদালত থেকে বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে (পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য)। ধারা ৪০১ রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন করার বিশেষ অধিকার কেড়ে নেয়নি। কাজেই যে কোন আবেদনকারী রায় মেনে নিয়ে উচ্চ আদালতে আপীল প্রত্যাহার করে রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেলে, ফৌজদারি দ- প্রশমন হতে পারে। তবে ৪০১ (৫এ) ধারা মতে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিঃশর্ত না হয়ে শর্তসাপেক্ষেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে কোন শর্ত যদি রাষ্ট্রপতি ক্ষমাপ্রার্থী ব্যক্তিকে দেন, তা দণ্ডদানকারী আদালতের আদেশের মতো করেই প্রয়োগ করা যাবে। তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন করবেন কি না তা একান্তই রাষ্ট্রপতির বিবেচনার বিষয়। সবশেষে বলতে চাই, অনেকেই একটি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন এই বলে যে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তার সাজা মওকুফ করা হয়নি বা তাকে মুক্তি দেয়া হয়নি। শর্তসাপেক্ষে তাঁর দ- স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সরকার স্থগিতাদেশের সময় ৬ মাস মেয়াদে বৃদ্ধি করেছে। আবার শর্ত ভাঙলে যে কোন সময় সরকার স্থগিতাদেশ বাতিল করে দিতে পারে। সরকারের নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শন বা শাস্তি কমানো কিংবা মওকুফ করার ক্ষমতা রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, যেহেতু দণ্ড স্থগিতকরণ বা হ্রাসকরণ অপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণ করে না, বরং দোষী প্রমাণ করে, ফলে তার দ-াদেশ এখন পর্যন্ত সক্রিয় আছে। লেখক : সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং সহকারী পরিচালক, ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিকট, ল এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
×