ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রাজদূতের বিদায় প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২৯ অক্টোবর ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ রাজদূতের বিদায় প্রস্তুতি

মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবারকে ‘আখেরি চাহার শম্বা’ নামে স্মরণ করা হয়। ‘আখেরি চাহার শম্বা’ ফার্সী বাক্য। এর অর্থ শেষ বুধবার। এদিন আখেরি নবী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) জীবনের অন্তিম রোগে কিছুটা উপশম বোধ করেছিলেন বলে মদিনাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে পরম আনন্দের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। তা স্মরণে এনে প্রতিবছর কোন কোন দেশের মুসলমানরা এদিনটিকে আল্লাহর কাছে বিশেষ শোকরিয়া জ্ঞাপনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। (ই. বিশ্ব কোষ ১/১১৩)। কাজ শেষে রাজদূত যেমন স্বদেশ ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, মহানবী (সা.)-এর অবস্থা ঠিক তেমন হয়েছিল। বিদায় হজের পর তিনি কেন যেন বিমনা হয়ে পড়েন। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে যেন কোন বার্তা তিনি শুনতে পেলেন। তাঁর বয়স তখন ৬৩ বছর। মীনা প্রান্তরে ৩০ পারা কুরআনের শেষ আয়াত যেদিন নাযিল হলো, সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর মিশন ফুরিয়েছে, শীঘ্রই তাঁকে এখান থেকে ফিরতে হবে, হাজিরা দিতে হবে মহামহিম আল্লাহ তায়ালার দরবারে। এ মহাপ্রস্থানের মহামুহূর্ত কখন ঘনিয়ে আসবে তাও তিনি জানতেন। এক স্নিগ্ধ রাত দুপুরে তিনি আপন খাদিম আবু মুহায়মা (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকীতে’ গমন করেন। যেখানে তিনি অতি বিনয়াদ্রভাবে জিয়ারত করেন আর বলেন- আস্সালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর...! ওহে সমাধিশায়িতরা! তোমাদের ওপর সালাম বা আল্লাহর শান্তিধারা বর্ষিত হোক। আমরাও (আমিও) শীঘ্রই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব।’ তাঁর হৃদয়কাড়া মোনাজাতের ভেতর দিয়ে এমন এক মর্মস্পর্শী সুর বেজে উঠল যেন কোন ব্যক্তি জীবনের শেষ মুহূর্তে তার আত্মীয়-স্বজন হতে বিদায় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ক্রমেই তাঁর রোগ বৃদ্ধি পেতে লাগল। জ্বর এবং পেটের পীড়া দুটোই তীব্র হয়েছিল তাঁর। এ সময় বারে বারে তিনি বলতে লাগলেন- ‘খায়বারে ইয়াহুদীনি যে বিষ খাইয়েছিল এর বিষক্রিয়া এখন আমি অনুভব করছি।’ হযরতের এই অসুস্থাতার দিনে মেয়ে ফাতিমা (রা.) ছুটে এলেন তাঁকে দেখতে। তিনি গোপনে মেয়েকে কি যেন বললেন। অমনি মেয়ে উচ্ছ¡সিত আবেগে কাঁদতে লাগলেন। তারপর হযরত কানে কানে আর একটা কথা শুনালেন। এতে ফাতিমা শান্ত হন। হযরত আয়িশা (রা.) অবাক হয়ে বাপ মেয়ের কান্না-হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ফাতিমা (রা.) বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রহস্য ব্যক্ত করব না।’ অবশ্য পিতা ওফাতের পর তিনি ছোট মাকে জানিয়েছিলেন- বাবা আমাকে সংগোপনে বলেছিলেন, ঐ রোগেই তাঁর ইন্তেকাল হবে। এটা ছিল আমার কান্নার কারণ। পরক্ষণে জানালেন- পরিজনের মধ্যে সর্বপ্রথম আমি তাঁর সঙ্গে মিলব। এটাই ছিল আমার সান্ত¦না প্রাপ্তির কারণ। উল্লেখ্য, সেদিনের ভবিষ্যদ্বাণী মহানবী (সা.)-এর ওফাতের বেলায় যেমন সত্যি হয়েছিল, ফাতিমা (রা.)-এর ওফাতের বেলায়ও সত্যি হয়েছিল। তিনি তার প্রিয়তম পিতার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন (বা পরকালে পাড়ি জমালেন) মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে, হুজুর (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র দুই মাস ব্যবধানে। সফর মাস ফুরিয়ে এলো রবিউল আউয়াল মাস। কিন্তু মহানবী (সা.) আর পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেননি। বিদায় লগ্নের সব আলামতই যেন ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠল। ৬৩২খ্রিঃ/১২ রবিউল আউয়াল ১১ হিজরী নূর নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর ওফাত সংঘটিত হয়। এর আগের মাসের ২৮ তারিখ সিরিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে সংবাদ পেয়ে মহানবী (সা.) মুসলমানদের সিরিয়া অভিযানে যেতে আদেশ প্রদান করেন। পরদিন নবী (সা.) এক ব্যক্তির জানাজার নামাজ হতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। পথিমধ্যে তিনি মাথার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন। পথ চলতে পারছেন না দেখে হযরত আলী (রা.) এবং হযরত আব্বাস (রা.) দু’জনে নবীজির দুই বাহু ধরে তাঁকে বিবি আয়েশা (রা.)-এর প্রকোষ্ঠে পৌঁছে দেন। এর পর থেকে প্রিয়নবী (সা.) দীর্ঘ সময় বিশ্রামে। জিকির আজকার ও প্রভুর স্মরণে সময়ক্ষেপণ করেন। বিবি আয়েশা (রা.) বলেন- রোগাক্রান্ত হলে নবীজি দোয়া পাঠ করে নিজের হাতে ফুঁক দিয়ে সেই হাত দিয়ে শরীর মুছে নিতেন, কখনও কখনও আমিও সেই দোয়া পাঠ করে নবীজির হাতে ফুঁক দিতাম। তিলাওয়াত করতাম সূরা নাস, সূরা ফালাক। আমার ইচ্ছা ছিল তাঁরই হাত দিয়ে তাঁর শরীর মুছে দেব। কিন্তু তিনি হাতখানি পশ্চাতের দিকে টেনে নিয়ে বলতেন- ‘হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা কর এবং তোমার সান্নিধ্য দান কর।’ অসুখের দ্বিতীয় দিবস সোমবার নবীজির জ্বর হয়। সে সময় পেটেও তিনি যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন। তিনি বলেন, খাইবারে ইহুদী মেয়েটি তাঁকে যে বিষ খাইয়েছিল এটা সেই বিষের যন্ত্রণা। চতুর্থ দিবস বুধবার যন্ত্রণা লাঘবের জন্য তাঁর মাথায় সাত মোশক পানি ঢালা হয়। এতে তিনি কিছুটা আরামবোধ করেছিলেন। নবীজির অসুস্থতার সংবাদ জানার পর হতেই মদিনার আনসারগণ কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছিলেন। নবীজি এটা জানতে পেরে সাহাবাদেরকে ডেকে বললেন, ‘মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আনসারগণ খাদ্যের মধ্যে নিমকের ন্যায় থাকবে। তাদের কোন ত্রæটি বিচ্যুতি হলে ওটা যেন উপেক্ষা করা হয়। রোগ বৃদ্ধি এবং শরীর ক্রমশ অধিকতর দুর্বল হতে থাকলেও নবীজি (সা.) ১১ দিন নিয়মিতভাবে মসজিদে গিয়েছিলেন। ওফাতের চারদিন পূর্বে বৃহস্পতিবারের দিনও মাগরিবের নামাজে তিনি ইমামতি করেন। ইশার নামাজেও তিনি শরিক হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। শয্যা ছেড়ে যতবার উঠতে চেষ্টা করলেন ততবারই বেহুশ হয়ে পড়ে যান। শেষবার চৈতন্য ফিরে আসলে তিনি বলেন, আবু বকর নামাজ পড়াবে। কিন্তু আবু বকর (রা.) সে স্থানে হাজির না থাকায় নামাজ পড়ার জন্য সকলে উমর (রা.) কে অনুরোধ করলেন। নবীজি পরপর তিনবারই বললেন, ‘আবু বকরই নামাজ পড়াবে’। আবু বকর (রা.) নামাজ পড়ালেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল, পদদ্বয় কাঁপছিল এবং নবীজির ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এইরূপ আবু বকর (রা.) মোট ১৭ বেলা নামাযের ইমামতি করেছিলেন। একদিন নবীজি আবু বকর (রা.) এবং তাঁর পুত্র আবদুর রহমানকে ডেকে এনে একখানি ফরমান লিখাতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু উমর (রা.) বললেন, অসুস্থ অবস্থায় নবী কারীম (সা.) কে কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া কুরআন মজিদই যখন রয়েছে তখন আর কিছু বাকি নেই। নবীজির ওফাতের দুইদিন পূর্বে আবু বকর (রা.) জোহরের নামাজ পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় নবী কারীম (সা.)-এর মন সেদিকে আকৃষ্ট হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ আলী (রা.) ও আব্বাস (রা.) এর কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে গমন করেন। মসজিদে তাঁর উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নামাজরত মুসল্লিগণ নবীজির দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে যান। আবু বকর (রা.)ও ইমামের আসন ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। নবীজি তাকে ইঙ্গিতে নিষেধ করে তারই পাশে নামাজ পড়লেন। ওফাতের একদিন পূর্বে নবীজি (সা.) ৪০ জন গোলাম আযাদ করে দেন। তাঁর ভাণ্ডারে সেদিন সাতটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তিনি বিবি আয়েশা (রা.) কে ডেকে বললেন- ‘দুনিয়ার ধনদৌলত ঘরে সঞ্চিত রেখে আমি আমার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাত করব, এটা খুবই লজ্জার কথা। তুমি দীনারগুলো দীন দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দাও’। বিবি আয়েশা (রা.) দীনারগুলোসহ গৃহের অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীও এমনভাবে দান করে দিয়েছিলেন যে, বাতি জ্বালানোর মতো এতটুকু তেল পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না। সন্ধ্যার পর এক প্রতিবেশীর নিকট হতে তেল ধার করে এনে বাতি জ্বালাতে হয়েছিল। রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ (মতান্তরে ১২ তারিখ) সোমবার সূর্যোদয়ের পর থেকে নবীজির চেতনা ঘন ঘন লোপ পেতে থাকে। তাঁর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়তে দেখে ফাতিমা (রা.) কাঁদতে লাগলেন। নবীজি তাঁকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, মা তুমি কেঁদনা। আমি চলে গেলে তোমরা শুধু বলবে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ অতঃপর তিনি ফাতিমা (রা.)-এর পুত্রদ্বয় হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) কে কাছে ডেকে এনে চুম্বন করেন। স্বীয় বিবিগণকেও তিনি সে সময় নানা উপদেশ দান করেছিলেন। এরপর নবীজি তিনবার হাতখানি উপরের দিকে উঠিয়ে ক্ষীণস্বরে আল্লাহুম্মার রাফীকিল আলা সেই প্রিয়তম বন্ধুকেই উচ্চারণ করলেন। তৃতীয়বার উচ্চারণের পর তাঁর হস্তদ্বয় মুবারক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। আয়েশা (রা.) তাড়াতাড়ি হুজুর (সা.)-এর মস্তক স্বীয় বক্ষে তুলে নিয়ে তাঁর হস্তপদ আস্তে আস্তে মালিশ করতে লাগলেন। ‘রাসূল (সা.) মৃদুস্বরে বললেন- হাত সরিয়ে নাও।’ মুহূর্তের মধ্যে নবীজির মুবারক রুহ অনন্তের উদ্দেশে তাঁর দেহ হতে নিষ্ক্রান্ত হলো। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।- নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব (২: ১৫৬)। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
×