ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা ॥ জনজীবনে চাপ পড়ার শঙ্কা

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০২১

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা ॥ জনজীবনে চাপ পড়ার শঙ্কা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ করোনার ধকল কাটিয়ে আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে পূর্ণোদ্যমে চালু হয়েছে দেশের সব খাত। ফলে আবারও রাজপথে বেড়েছে যানবাহনের চাপ। এই অবস্থায় বিশ^ বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জ¦ালানি তেলের দাম। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেও বাংলাদেশের চাইতে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল কিংবা ফার্নেস অয়েল। তুলনামূলক কম দাম হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে তেল পাচারের শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এই অজুহাতেই বিশ^বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশেও জ¦ালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। এমনিতেই নিত্যপণ্য অন্যান্য পণ্য উর্ধমূল্যে কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে এমন অবস্থায় জ¦ালানি তেলের দাম বাড়লে জনজীবনে মারাত্মক চাপ পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনটি যদি হয় তাহলে মড়ার ওপর অনেকটা খাড়ার ঘা পড়বে বলে দাবি করছেন সাধারণ মানুষ। দফায় দফায় দাম বেড়ে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৩ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে তেলের দাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ^বাজারে তেলের মূল্য বাড়ার প্রবণতা শুরু হয় ২০২০ সালের নবেম্বর মাস থেকেই। চলতি বছরের জুন থেকে এর প্রবণতা আরও বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর গত জুনে করোনার প্রকোপের মধ্যে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল ৭৫ ডলারে ওঠে। দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকায় চলতি মাসে সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল ৮০ ডলার স্পর্শ করে। কিন্তু বিশ^ বাজারের তুলনায় বাংলাদেশের জ¦ালানি মূল্য অনেকটাই কম বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। বিপিসি বলছে, ২০ অক্টোবরে বিশ^বাজারে ডিজেলের ব্যারেল প্রতি ৯৪ দশমিক ৫৯ মার্কিন ডলার। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে লিটার প্রতি ৬৫ টাকায়। সে হিসেবে ডিজেলের জন্য বিপিসির লিটার প্রতি ক্ষতি ১৩.৭৭ টাকা। এছাড়া একই সময়ে ফার্নেস অয়েলের ব্যারেল প্রতি মূল্য ছিল ৪৮৭.২১ মার্কিন ডলার। এর প্রেক্ষিতে ফার্নেস অয়েলের লিটার প্রতি বিক্রয় মূল্য ৫৩ টাকা থাকলেও চলতি মাসের ৭ তারিখ এর মূল্য লিটার প্রতি ৫৯ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সে হিসেবে ফার্নেস অয়েলের জন্য বিপিসির লিটার প্রতি ক্ষতি ৫.৭৩ টাকা। দামের এই চিত্রের প্রেক্ষিতে বিপিসি দাবি করছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ক্ষেত্রে বিপিসির দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে ২০ কোটি টাকার বেশি। বিপিসি ২৪ অক্টোবর ভারতের ডিজেলের বাজার মূল্যের তুলনা করে জানায়, এদিন দেশটিতে ডিজেলের বাজার মূল্য লিটার প্রতি ৯৯.৪৩ রুপী ছিল। যা বাংলাদেশী টাকায় ১২৩.২৪ টাকা। এর ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিজেলের মূল্য ব্যবধান লিটার প্রতি প্রায় ৫৮.২৪ টাকা। ফলে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভর্তুকি প্রদানকৃত ডিজেল ভারতে পাচার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সাধারণত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল ও মেরিন ফুয়েলের মতো অন্য তরল জ¦ালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিপিসির কাছে অর্পণের দাবি জানায় সংস্থাটি। সংস্থাটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, পাচার এবং বিশ^ বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের অজুহাতে দেশে জ¦ালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, জ¦ালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এছাড়া বিদেশ থেকে আনতে হয় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন এসব জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ছয় মাসে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল বিক্রিতে দিনে ২১ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ফলে বছর শেষে এ ক্ষেত্রে লোকসান চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। লোকসান কমাতে গ্যাস-তেলের মূল্য বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ বিষয়ে বিদ্যুত, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাস-কয়লা সবকিছুর দাম অনেক বেড়েছে। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করায় সরকারের লোকসান হচ্ছে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে দাম কম থাকায় বাংলাদেশ থেকে ডিজেল-ফার্নেস অয়েলসহ অন্যান্য জ¦ালানি তেল পাচার হওয়া নিয়ে। শুধু পেট্রোলই নয়, ডিজেলের দামও দেশটির কোন কোন রাজ্যে আমাদের থেকে অনেক বেশি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্য অনেক বেশি। তাই সীমান্ত দিয়ে পাচারের শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় দাম বাড়ানো খুব জরুরী। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে পাচার রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পাচার রোধে সীমান্তে তো নির্দেশনা জারি আছেই। কিন্তু কেউ যদি ড্রামে করে বা ছোট ছোট বোতলে করে এটি পাচার করে তাহলে কি করার থাকতে পারে। তিনি বলেন, ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি দেশে একই ধরনের পণ্যের দামে অবশ্যই ভারসাম্য থাকতে হবে। আমাদের এখানে সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়, ভারত উল্টো ট্যাক্স আরোপ করে। কেন্দ্রীয় সরকার এক ধরনের ট্যাক্স বসায়, আঞ্চলিক সরকারগুলো আবার তাদের মতো করে ট্যাক্স বসায়। তাই রাজ্যভেদে দামও ভিন্ন ভিন্ন। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে স্থানীয় পর্যায়েও দাম বাড়ায়, আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে স্থানীয় পর্যায়ে কমায়। সারা বিশ্ব এভাবেই চলে। এটা হলে পাচারের ঝুঁকি থাকে না। শুধু বাংলাদেশই উল্টো চলে। এখানে এক দামেই চলছে পাঁচ বছর। এছাড়া বছরের পর বছর জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। ভারত তো প্রতি মাসেই দাম বাড়ায়। আর আমাদের ভর্তুকি দিতে হয়। বিশ^বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে জ¦ালানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ সাংবাদিকদের জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিজেল ও ফার্নেসে তারা প্রতিদিন ২১ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিচ্ছেন। বিষয়টি সরকারকে জানানো হবে। দাম বাড়বে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
×