ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের দীর্ঘমেয়াদী পন্থা

প্রকাশিত: ২০:০০, ২৪ অক্টোবর ২০২১

সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের দীর্ঘমেয়াদী পন্থা

গার্মেন্টস কর্মীদের একটি সাধারণ রোগের নাম হচ্ছে চর্মরোগ অর্থাৎ গার্মেন্টসের পরিবেশে কর্মীরা নানা রকমের রোগ সৃষ্টির অনুষঙ্গ প্রতিবেশগত কারণেই পেয়ে থাকে তার মধ্যে চর্মরোগ অন্যতম। এই চর্মরোগ নিরাময়ের জন্য উক্ত গার্মেন্টসে কর্মরত চিকিৎসকরা কর্মীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন। রোগীদের কাছে পরামর্শ থাকে, হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে প্রকৃত রোগ শনাক্ত করার জন্য। উল্লেখ্য, রোগ নির্ণয়ের সুযোগ-সুবিধা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে থাকে না। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা পেয়ে খানিকটা আরোগ্য লাভ করে কর্মীরা এবং সাধারণত বাইরে পরীক্ষা করিয়ে রোগ নির্ণয় করা আর কখনই হয়ে ওঠে না। ফলে এভাবেই তারা প্রতিনিয়ত চর্মরোগের চিকিৎসা করছে কিন্তু সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের গাফিলতি থেকেই যায়। সেক্ষেত্রে চর্ম রোগের বাহক বহন করেই তাদের চলতে হচ্ছে, মাঝে মাঝে শুধু সামান্য সময়ের জন্য আরোগ্য পাওয়া যায়। কার্যত এটা শতভাগ নিরাময়ের উপলক্ষ এনে দিতে পারে না। প্রয়োজন যথাযথ প্রক্রিয়ায় রোগ নির্ণয় করে দীর্ঘমেয়াদী আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় চিকিৎসা গ্রহণ করা। রোগমুক্তির জন্য কাজের কাজটি কখনই করা হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব না হলে আমরা যতই শূন্য সহিষ্ণু নীতির প্রয়োগ ঘটাই না কেন সন্ত্রাসবাদের হুমকি এবং ভয়াবহতা থেকে কখনই আমাদের মুক্তি ঘটবে না। ঘটনা ঘটছে, ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা হলেই কিন্তু দায়িত্ব শেষ হয় না। পুরোপুরি মুক্তির জন্য শিকড়ে হাত দিতে হবে, শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। সংবাদে জানা যায়, করোনাকালীন সময়েও সন্ত্রাসীরা থেমে ছিল না। অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে সদস্য সংগ্রহ, সদস্যদের প্রশিক্ষণ, চাঁদা সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ নির্দ্বিধায় করে গেছে। আবার গ্রেফতারের সংবাদও পাওয়া গেছে। কাজেই সন্ত্রাসীদের উর্বর ভূমি হিসেবে এখনও বাংলাদেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষক এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ব্যতিরেকে কখনই সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন সম্ভব হবে না। অতীতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ জঙ্গীদের বিভিন্ন উপায়ে প্ররোচনা ও সহায়তা দিচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে রাজনৈতিক অবকাঠামো, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সরকার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির সঙ্গে সমগোত্রীয় হারে সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের মনে এখনও বদ্ধমূল ধারণা, সরকার চাইলে অপরাধের মাত্রা যে কোন সময় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারে। কারণ হিসেবে বলা যায়, সরকারের যে সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক, এর ফাঁক গলে অপরাধীরা কখনই গা-ঢাকা দিতে পারবে না। তাহলে স্পষ্টত বোঝা যায়, সরকারের সদিচ্ছার অভাব কিংবা সরকার যাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে তাদের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলে থাকছে না তথাপি হুমকির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাসবাদ নিরসনের জন্য যথার্থই অনেক গ্রহণযোগ্য ও ইতিবাচক পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুধু প্রলেপই দেয়া হবে, ক্ষত কখনও নিঃশেষ হবে না। সে কারণেই গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। সমস্যা একবার সুনির্দিষ্ট করা গেলে দেশব্যাপী বিভিন্ন উপায়ে জরিপ করে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার, সন্ত্রাসবাদের উৎস, সন্ত্রাসবাদের কারণ, সন্ত্রাসবাদের মেকানিজম, সন্ত্রাসবাদ প্রতিকার ও প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে একটি কোলাবোরেটিভ উপসংহারে পৌঁছা সম্ভব হবে। এমন একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নই পারে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদের হুমকি ও ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ দিতে। সে জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ ও প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যার প্রেক্ষিতে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা সন্ত্রাসবাদের ধরন, প্রকৃতি, সন্ত্রাসী হওয়ার প্রক্রিয়া, সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক, সন্ত্রাসে সম্পৃক্ত হওয়ার লাভ-ক্ষতি সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করার প্রয়াসই সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। মূল বিষয় হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটাকে সব সময় আলোচনার মধ্যে রাখতে হবে যাতে প্রত্যেকেই ইস্যুটাকে বুঝতে পারে, অনুধাবন করতে পারে এবং তার ভিত্তিতেই পরিবারের সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মতানৈক্যে আসতে হবে। রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া কোন ধরনের অপরাধকে সমূলে নিপাট করা সম্ভব হবে না। আবার অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে যত সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিংবা হচ্ছে প্রত্যেকেরই কোন না কোন রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। না হলে সন্ত্রাসীরা কখনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। এমন অভিযোগও পাওয়া যায়, সন্ত্রাসীদের অনেকেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলস্বরূপ রাজনৈতিক শিষ্টাচার, শালীনতা, রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। কাজেই, কিছু মৌলিক এবং কার্যকরী বিষয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো বটেই, না হলে সামষ্টিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সংলাপের আয়োজন করতে হবে। বিরোধ, অবিশ্বাস, বিশৃঙ্খলা নিরসনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো সংলাপ। সংলাপের নানাবিধ গুরুত্ব রয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কোন জরুরী ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মীমাংসার জন্য সংলাপের আশ্রয় নিতে হয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবেও সংলাপের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সংলাপের আয়োজনে বেশ ফলপ্রসূ ফলাফলও এসেছে। এমনও হয়েছে, সন্ত্রাসবাদের দাপট থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা প্রদানের স¦ার্থে সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও দায়িত্ব প্রাপ্তদের সংলাপের ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে চমৎকার কিছু সিদ্ধান্ত ও সমাধান বের হয়ে এসেছে। সংলাপের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি করে সুপারিশ আদায় করা যেতে পারে যার প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদ প্রতিকার ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি সামষ্টিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যেতে পারে। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি যারা প্রকৃত অর্থেই সন্ত্রাসবাদের সমস্যাকে নিঃশেষ করে দিতে চায়, তাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি, কনভেনশনে স্বাক্ষর করা যেতে পারে। এর ফলে সন্ত্রাসবাদকে দমনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সহায়তা বিনিময় কর্মসূচী চালুর ফলে সন্ত্রাসীদের খুব সহজেই পাকড়াও করা সম্ভব হবে। একটি পক্ষ রয়েছে যারা সন্ত্রাসবাদবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করে অথচ তারা সন্ত্রাসবাদকে বিভিন্নভাবে জিইয়ে রেখে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে থাকে এবং এ পক্ষকে খুব সচেতনভাবে কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করে প্রতিহত করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ নিরসনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যেতে হবে। বিশেষ করে মানি লন্ডারিং বন্ধ করতে হবে, অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা প্রতিহত করতে হবে, অস্ত্রের সরঞ্জামাদি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ব্যতীত আমদানি-রফতানি ব্যতিরেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সুতরাং সন্ত্রাসবাদের অভিশাপকে চিরতরে কারাগারে পাঠানোর নিমিত্তে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরামহীন পরিশ্রম করে যেতে হবে। অন্যথায় ভেতরে সমস্যা রেখে শুধু প্রলেপই দেয়া হবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না। রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্সি ইউনিট ও পুলিশ বাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী, উজ্জীবিত ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কঠোর শৃঙ্খলার মাধ্যমে নিয়োগদান সম্পন্ন করার পরবর্তী সময়ে উন্নত প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তিমনস্ক অফিসার তৈরি, পঠন-পাঠনে আগ্রহী করে গড়ে তোলা, সৎ ও নীতিবান অফিসারদের হস্তক্ষেপ ব্যতীত দায়িত্ব পালনের অবাধ স্বাধীনতা প্রদানই পারে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদের ভয় ও হুমকি থেকে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। সেক্ষেত্রে জনসাধারণকে সন্ত্রাসবাদ নিরসনের জন্য বিশেষায়িত ইউনিটকে তথ্য প্রদান করে সহযোগিতা করার পাশাপাশি উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই সন্ত্রাসবাদের বিষবাষ্পের ধোঁয়া ডানা মেলে দাঁড়াতে পারবে না। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×