ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একটি অপ্রীতিকর ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধুর দেয়া সমাধান

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১৯ অক্টোবর ২০২১

একটি অপ্রীতিকর ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধুর দেয়া সমাধান

১৯৭৪ সালে অস্ত্র উদ্ধার এবং চোরাচালান বন্ধ করতে বঙ্গবন্ধু সারা দেশে সেনাবাহিনী নামালেন। ওই সময় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হলো বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হাতে। ঢাকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিমানবাহিনী-ইউনিটের প্রধান ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার নবী। একদিন আমি আমার মেয়ে অনিতাকে নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে গেলাম। সেদিন আমার কোন ডিউটি ছিল না। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর অনিতা এ্যারোপ্লেন দেখতে চাইল। বিমানবন্দরের টার্মিনাল বিল্ডিং পেরিয়ে বাপ-মেয়েতে হাত ধরাধরি করে সেদিকেই যাচ্ছিলাম। সিভিল এভিয়েশন বিভাগের নিরাপত্তারক্ষীদের সবাই আমাকে চিনত বলে তাদের কেউই আমাকে টারমাক এলাকায় যেতে বাধা দিল না। ওই এলাকায় পা রাখতেই শুনতে পেলাম, কে যেন আমাকে ডাকছে। ফিরে তাকিয়ে দেখি বিমানবাহিনীর একজন অফিসার তাঁর ডান হাতের তর্জনী বাঁকা করে উঁচিয়ে ধরে আমাকে ডাকছেন। অমন বিশ্রী ভঙ্গিমায় ডাকার জন্য আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। বিমানবাহিনীর অফিসার ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার নবী। আমার পরিচয় পেয়েও তিনি আমার ওপর খুশি হতে পারলেন না। তাকে বললাম, আপনার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখনও পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে আছেন। দেশটা এখন স্বাধীন হয়েছে। আপনি আছেন এখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়েছিল ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ডিমাপুরে। দশজন পাইলট নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়েছিল, আমি ছিলাম একজন। পদমর্যাদা ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীর প্রতীক খেতাব অর্জন করেছি। আমার কথায় নবী কর্ণপাত করলেন না। তিনি দুজন সিপাহীকে হুকুম করলেন, আমাকে ট্রেসপাসার হিসেবে গ্রেফতার করতে। প্রথম ভেবেছিলাম লোকটা পাগল। পরে দেখলাম লোকটি পাগল বা নির্বোধ নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষ তাকে নির্বোধ করে তুলেছিল। আমাকে গ্রেফতার করার এখতিয়ার তার ছিল না। এটুকু বোঝার ক্ষমতাও তার ছিল না। তাই আমাকে অপমান করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। নবীর ব্যবহারে হতভম্ব হয়ে আমি তাকে বললাম, আপনি বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করুন। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। এবার নবী দমে গেলেন। আমিই টেলিফোনের নম্বর ঘুরিয়ে খন্দকার সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে সমস্ত ব্যাপারটা বললাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে নবীকে টেলিফোনটা দিতে বললেন। খন্দকার সাহেব নবীকে কি বলেছিলেন সেটা আমি শুনতে পাইনি। নবী শুধু স্যার স্যার, বলে যাচ্ছিলেন। এরপর নবী আমার সঙ্গে বেশ সমীহ করে কথা বলতে শুরু করেন। বললেন, ‘আই এ্যাম সরি, এক্সট্রিমলি সরি।’ আমি আমার মেয়ে অনিতাকে নিয়ে চলে আসি। ওর আর ওইদিন এ্যারোপ্লেন দেখা হলো না। ॥ দুই ॥ কয়েকদিন পরের ঘটনা। সকালে সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের মিঃ শোহারব টেলিফোন করে জানালেন, ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন এবং স্কোয়াড্রন লিডার নবীর মধ্যে বড় রকমের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। অন্য পাইলটরা ফ্লাইংয়ে যেতে অস্বীকার করেছেন। বিমানের ফকার ফ্লিটের চীফ পাইলট হওয়ায় বিমানবন্দরে আমার দ্রুত উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি ওখানে পৌঁছে গেলাম। পৌঁছেই পাইলট এবং বিমানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলাম। সবাই বলল, ক্যাপ্টেন শাহাবকে স্কোয়াড্রন লিডার নবী যথেষ্ট অপমান করেছেন এবং তার নির্দেশে বিমানবাহিনীর সিপাহীরা শাহাবকে আটকে রেখেছে। আসল ঘটনা ছিল খুবই সামান্য। তাকে নবী এমন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন যে, বিমানের অন্য কর্মচারীরাও কর্মবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। ক্যাপ্টেন শাহাব ফ্লাইট নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় ওই ফ্লাইটের একজন কেবিন ক্রুর সঙ্গে বিমানবাহিনীর নিরাপত্তারক্ষীদের একজনের ঝগড়া হয়। নবী ওই কেবিন ক্রুকে প্লেন থেকে নামিয়ে নেয়ার হুকুম দেন। ক্যাপ্টেন শাহাব তাতে বাধা দেন। ক্যাপ্টেনের অনুমতি ছাড়া তাঁর ক্রুদের কাউকে নামিয়ে নেয়ার অধিকার নবীর ছিল না। কেবিন ক্রুকে নামিয়ে নিতে বাধা দেয়ায় নবী বিমানবাহিনীর দুজন সিপাহীকে হুকুম করেন শাহাবকে ধরে নিয়ে যেতে। শাহাব বিমানবাহিনীর জন্মলগ্নের সদস্য। অমিত বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। এটাই ছিল শাহাবকে তার অপমান করার মূল কারণ। আমি বিমানবন্দরে নবীর রুমে গিয়ে দেখলাম, ক্যাপ্টেন শাহাব নবীর সামনে একখানা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। নবীর চোখেমুখে একটা অস্থিরতার ছাপ দেখতে পেলাম। শাহাবকে অপমান করার ফলে বিমানের সব কর্মচারীর মধ্যে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে নবী সেটা বুঝতে পারেননি। আমি নবীকে বললাম, শাহাব আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তাদের সব জানানো হবে। তারা সম্মিলিতভাবে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নবী নিজেই বুঝতে পারছিলেন এবার তিনি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। নবীর রুম থেকে বেরিয়ে এসে বিমানবন্দরের ক্রু-রুমে হাজির হলাম। সব পাইলট উপস্থিত ছিলেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নবীকে ডিউটি থেকে অপসারণ না করা হলে কেউ আর কাজে যোগ দেবেন না। বিমানের তখনকার এ্যাডমিনিস্ট্রেটর মোসলে উদ্দিন অনেক আশ্বাস দিয়েও পাইলট এবং অন্য কর্মচারীদের কাজে যোগদান করাতে সমর্থ হলেন না। বিকেল তিনটায় আমাদের জানানো হলো, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবনে পাইলটদের প্রতিনিধি, বিমান এবং বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সিদ্ধান্ত হয় ক্যাপ্টেন মুকিত এবং ক্যাপ্টেন ইসফাক পাইলটদের প্রতিনিধি হিসেবে এবং ক্যাপ্টেন সাইফউদ্দিন যাবেন ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে। বিমানের মুক্তিযোদ্ধা এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমিও সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গণভবনের মীমাংসা বৈঠকে একটু দেরিতেই হাজির হয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ঢুকে দেখলাম বঙ্গবন্ধু একখানা চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর আসন থেকে দশ-বারো হাত দূরে বসে আছেন বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার, বিমানের এ্যাডমিনিস্ট্রেটর মোসলে উদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন রকিব। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কিছু দূরে বসে আছেন ক্যাপ্টেন সাইফউদ্দিন, মুকিত এবং ইসফাক। সবাই দাবি করলেন, স্কোয়াড্রন লিডার নবীকে অপসারণ করতে হবে। আমাকে ঢুকতে দেখে বঙ্গবন্ধু হাতের ইশারায় আমাকে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে নিজের হাতে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বললেন। বক্তব্য শেষ হতেই বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললেন : ১. এই মুহূর্তে বিমানের পাইলট এবং অন্য কর্মচারীরা ডিউটি শুরু করবে। ২. আজকের ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ৩. তদন্ত শেষে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর দেয়া নির্দেশে স্কোয়াড্রন লিডার নবীকে ডিউটি থেকে অপসারণ করার নির্দেশ ছিল না। হঠাৎ করেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল। একটু রাগ করেই বঙ্গবন্ধুকে বললাম, কাকে কাকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হবে? কোন কমিটিই যথাযথ তদন্ত করে না এবং আপনার কাছে সঠিক রিপোর্ট দেয় না। আপনার গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনও সঠিক রিপোর্ট দিচ্ছে না। তাই বর্তমানে দেশের অবস্থা সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। আমি রাগের মাথায় আর কি কি বলেছিলাম আজ আর তা মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, কেউ জাতির পিতার সামনে অমন রাগত স্বরে অমন সব কথা বলতে পারে না। আমি পেরেছিলাম। কারণ এর আগেও অনেক লেখায় উল্লেখ করেছি বঙ্গবন্ধুকে আমি জাতির পিতা বা প্রধানমন্ত্রী মনে করতাম না। নিজের পিতার মতোই মনে করতাম। আমার বয়স যখন খুব কম ছিল তখন আমার বাবা মারা যান। আমার এখনও মনে আছে, বাবা আমাকে বকাঝকা করলে আমিও রাগ করে তাঁকে যা-তা বলতাম। পুলিশকে মানুষ যেমন ভয় করে বাবাকে আমি তেমন ভয় করতাম না। বাবাকে বাবা বলেই মনে করতাম। বাবাকে আমি যেমন শ্রদ্ধা করতাম, ভালবাসতাম, বঙ্গবন্ধুকেও তেমনি শ্রদ্ধা করতাম এবং ভালবাসতাম। বঙ্গবন্ধুও আমাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। যা হোক, আমার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্দেশনা ঠিক রাখলেন। একই সঙ্গে যোগ করলেন- স্কোয়াড্রন লিডার নবীকে দু-একদিনের মধ্যে অপসারণ করতে হবে এবং তাঁর জায়গায় অন্য কেউ তাঁর ডিউটির দায়িত্ব পালন করবে। শাহাবের সঙ্গে নবীর অনভিপ্রেত ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। নবী তখনও তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা প্রধানের দায়িত্বে আছেন দেখে আমরা বিমানের পাইলটরা খুব অপমানবোধ করছিলাম। শাহাব আর আমি আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম, আপনার নির্দেশমতো এখনও নবীকে বিমানবন্দরের ডিউটি থেকে সরানো হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আমরা তো বিমানবাহিনীকে অপছন্দ করি না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা তো বিমানবাহিনীতেই ছিলাম। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে নিয়ে আমরা চিরদিন গর্ব করব। বিমানবাহিনী তো আমাদের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। আমরা চাই নবীর স্থলে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া হোক। সবচেয়ে ভাল হয় স্কোয়াড্রন লিডার নবীর জায়গায় স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলমকে ওই দায়িত্ব অর্পণ করলে। শামসুল আলম মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন। এমন পরিবর্তনে বিমানবাহিনীর অখুশি হওয়ার কথা নয়। বিদায় নিয়ে আসার আগে বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করলেন, তোরা কার নাম বলছিলি? শামসুল আলম না? ঠিক আছে। একদিন পরেই দেখলাম নবীর জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন আমাদের বন্ধু এবং সহযোদ্ধা শামসুল আলম বীর উত্তম। লেখক : বীরপ্রতীক, সাবেক বৈমানিক, কিলোফ্লাইট
×