ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালী জাতির অলঙ্কার

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১৬ অক্টোবর ২০২১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালী জাতির অলঙ্কার

মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উৎসসূত্রে প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ ছিল বাঙালীর ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ। সকল ধরনের ধর্মান্ধতা পরিহারে ধার্মিকতার মানবিক-নান্দনিক-পরিশীলিত মূল্যবোধকে ধারণ করে স্বাধীনতা অর্জনের মূলমন্ত্র হিসেবে কার্যকর ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার এই জাতীয় আদর্শকে গুরুত্বসহকারে প্রাধান্য দিয়ে অধিকতর প্রাণিত করে চলছে। মূলত বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের সকল নাগরিকবৃন্দের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রাণস্পন্দন হিসেবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মেলবন্ধন অক্ষুণ্ণ রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা ঈদ-পূজাপার্বণ-আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি বাঙালী সংস্কৃতি-কৃষ্টির শাশ্বত ঐতিহ্যিক বৈশিষ্ট্যরূপে এখনও অত্যন্ত সমাদৃত। চলমান শারদীয় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে অনিন্দ্য সুন্দর আনন্দধারায় সমগ্র জাতি উদ্ভাসিত। কাল-পরিক্রমায় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রতিবছরের ন্যায় শরৎকালের সাদা মেঘ ও প্রকৃতির কাশফুল অকাতরে এ বছরও শারদীয় দুর্গাপূজার সার্বিক আয়োজনকে অবগাহন করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসবে শুভ মহালয়ার দিন-ক্ষণ থেকে চন্ডীপাঠের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। ঢাকের তালে তালে বাজনা বাজিয়ে পূজা-অর্চণায় দেবীর আরাধনা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয় পূজামন্ডপ কেন্দ্রিক এলাকাজুড়ে। সনাতন ধর্মের পঞ্জিকা মতে জগতের সামগ্রিক মঙ্গল কামনায় এবার ঘোটকে বা ঘোড়ায় চড়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমন এবং গতকাল স্বর্গালোকে বিদায় নিয়েছেন দোলায় বা পালকি চড়ে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে আগমনী-বিসর্জন বার্তা ছিল ফসল বা শস্যহানি-মড়ক। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সূত্রমতে, এবার সারাদেশে প্রায় ৩২ হাজার ১১৮টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর এর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার ২১৩টি। দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণ কমে আসায় ১ হাজার ৯০৫টি মন্ডপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সরকারের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে ৩১ হাজার ৭১৭টি মন্ডপে পূজা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বাঙালী হিন্দু সমাজের এই পূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের জন্য এই উৎসব একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অন্ধকারের শক্তিকে নিধন, অন্যায়-অবিচারের অপ ও বর্বর শক্তিকে সংহার করে আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এই ধরনের ধর্মীয় উৎসব শুধু বিশেষ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে নয়, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ্য-বন্ধুত্বের নিগূঢ় বন্ধনকে অনন্য উচ্চতায় এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শনের অভিনব পন্থা অবলম্বনে অন্য ধর্মে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও ধর্মের রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান প্রদান ও এই ধারণাকে মর্যাদাসীন করার লক্ষ্যে মানবিকতায় উজ্জীবিত চেতনার নামই অসাম্প্রদায়িকতা। এই জনপদে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানসহ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ ও সাবলীল বসবাস এই জাতির আবহমান সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট পরিচায়ক। বাংলা ভূখ-ে প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর এই ধরনের ঈদ-রোজা-মহরম-পূজাপার্বণ-বড়দিন- বৌদ্ধপূর্ণিমার সমীকরণে স্বজাত্যবোধের পরিচিতি নিরন্তর নন্দিত এবং প্রশংসিত। এই প্রসঙ্গে সূফি শাহ আবদুল করিমের গানটি অতি প্রণিধানযোগ্য। যদিও বর্তমান সময়ে আধুনিকতা বা জীবন যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত মানব পরিবার অনেক বেশি বিপর্যস্ত এবং ধর্মীয় চেতনাবোধে অনেকখানি বিভাজিত, তবুও বাঙালীর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে যে চিরন্তন মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা কার্যকর ছিল তা এখনও অত্যুজ্জ্বল ও দেদীপ্যমান। প্রয়াত সূফী শাহ আবদুল করিম কী চমৎকারভাবে এই বন্ধনকে সুস্পষ্ট করেছেন তারই উচ্চারিত গানে- ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ ...গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান- মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম,/ হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত- নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম,/ জারি গান, বাউল গান আনন্দের তুফান- গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম,/ বর্ষা যখন হইত, গাজির গান আইত, রংগে ঢংগে গাইত আনন্দ পাইতাম।/ কে হবে মেম্বার, কে বা গ্রাম সরকার - কি তার খরবও লইতাম।/ ... বিবাদ ঘটিলে পঞ্চায়েতের বলে- গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম।/ ...দিন হতে দিন আসে যে কঠিন - করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।’ আমরা সম্যক অবগত আছি, ফকির লালন শাহ আমৃত্যু জাতিভেদ তথা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি তীব্র ঘৃণা, অসন্তোষ ও বিদ্রোহ প্রকাশ করে হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপট রচনায় বহুভাবে তার উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেন। তার যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান/জাতি-গোত্র নাহি রবে। শোনায়ে লোভের বুলি/নেবেনা কাঁধের ঝুলি, ইতর-আতরাফ বলি/দূরে ঠেলেনা দেবে। আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই/সবার পাওনা খাবে সবাই, আশরাফ বলিয়া রেহাই ভবে/কেউ নাহি পাবে, ধর্ম-কূল-গোত্র-জাতি/তুলবে না গো কেহ জিগির, কেঁদে বলে লালন ফকির/কে মোরে দেখায়ে দেবে।’ উল্লেখ্য প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের কাব্যগাঁথা ‘আমি কিন্তু ডেকেই বসি/যেটাই মনে আসুক না, যারে ডাকি সেই তো বোঝে/আর সকলে হাসুক না।’ ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ, খোদা, গড, জিহোবা, ব্রহ্মা, কৃষ্ণ, মহেশ্বর, শীব ইত্যাদি নামে ধর্মের ভিন্নতা কী নিশ্চিত করা যায়। ‘ঈশ্বর-আল্লাহ’ আর ‘ভগবান-খোদা’ নিয়ে উপমহাদেশে ধর্মকে বিতর্কিত করা এবং বিরোধ-বিচ্ছেদ-সহিংসতা-নৃশংসতা ইত্যাদির নামই সাম্প্রদায়িকতা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার হিন্দু-মুসলমান নিবন্ধে কবিগুরুর সঙ্গে এদের ধর্মভেদ সমস্যা নিয়ে আলাপকালে তাঁকে গুরুদেব বলেছিলেন, ‘দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?’ বাংলার সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমান ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে বাংলাদেশ নামক এই অঞ্চলের মানব-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, চিন্তা- চেতনা ইত্যাদি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংমিশ্রণ, সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বস্তুত গাঙ্গীয় এ ব-দ্বীপ এলাকায় বাঙালীরা বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের প্রায় পনেরো’শ বছর আগে। দ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত এই জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের উৎসে ছিল কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি। আর্যদের দখলে আসার পর রাজনীতি, ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত থাকলেও শ্রী দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ভাষায় ‘বৈদিক যুগ থেকে আর্যরা অনার্য সভ্যতা গ্রহণ শুরু করে।’ ঐতিহাসিক বহু তথ্য থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশে আর্য হিন্দুদের শতবিরেধিতা সত্ত্বেও প্রচলিত অনার্যদের প্রচীন আমলের কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি- বধূবরণ, অন্নপ্রাশন, সংক্রান্তি, গৃহ প্রবেশ, জমি কর্ষণ, ফসল তোলা, আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত ও প্রথার বিলুপ্তি ঘটেনি বরং বৌদ্ধ, হিন্দু এবং সূফী মনীষীদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পরও এ ধরনের কৃষি ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো বাঙালী- সংস্কৃতির প্রধান আচার-অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের অস্তিত্বকে সমুজ্জ্বল করেছে। অতএব এ সব আচার-অনুষ্ঠানকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে আখ্যায়িত করার অব্যাহত প্রচেষ্টা যে এ দেশের কিছু সংখ্যক কুশিক্ষিত ধর্ম-ব্যবসায়ী ও সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতিবিরোধী ব্যক্তিবর্গের নষ্ট-ভ্রষ্ট মানসিকতার পরিচায়ক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মান্ধ নয়; বিশ্বের সকল ধার্মিক ও মনুষ্যত্ব-মানবিকতায় পরিশুদ্ধ মানুষ মাত্রই কালান্তরে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে যাদের সক্রিয় অবদান-প্রাণবিসর্জন রয়েছে, অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাদের স্মরণ করে থাকেন। যথার্থ অর্থে তাদের সুনাম-সম্মানকে সমাসীন করা না হলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোকিত ভবিষ্যত নির্মাণ অবশ্যই কষ্টদায়ক হবে। বিপরীতে পরাজিত অন্ধকারের অশুভ শক্তিও বিজয়ের আনন্দবার্তা ও গৌরবোজ্জ্বল পটভূমিকে শুধু কলুষিত করবে না; নানা অপকৌশলে বিকৃত ইতিহাসপাঠে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সকল নষ্ট সম্ভাবনাকে ঘৃণ্য পন্থায় কাজে লাগাবে। আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় যে কোন সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরন্তর প্রতিফলন অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। ভাব-বস্তুবাদী দর্শনের আপেক্ষিক সম্মিলনে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম ইহ ও পারলৌকিক বিশ্বাস এবং কর্মের ভিত্তিকে শক্তিমান করেছে। মূলত মানবিক মূল্যবোধের অনুরুদ্ধ বিকাশমানতা ও জনকল্যাণে নিবেদিত কর্মযজ্ঞের অনভিভূত ধারণায় ধর্ম যুগে যুগে নানা কাঠামোয় পল্লবিত হয়েছে। জাতি-বর্ণ-মানুষ-অঞ্চলভেদে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিপালিত ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণিল অবগাহনে ধর্মের চিরায়তরূপ জ্ঞাপিত। জীবনধর্মী কর্মপ্রবাহে ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য, সত্য-মিথ্যার দোলাচলে অদৃশ্য-অজানা অনুভূতির মানদন্ডে পারলৌকিক ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশায় ধর্মভিত্তিক আচার-আচরণ কখনও সমাজকে করেছে উজ্জীবিত; কখনও অতিশয় নিষ্প্রভ। সকলের জানা আছে যে, বিজ্ঞানের মতো ধর্মও একটি মূল্যবোধ। ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে নয় বরং একটি অনন্যসাধারণ বিশ্বাসের দিক থেকে বিবেচনা করলে ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিরোধ ততটা দৃশ্যমান নয়। ধর্মের বদ্ধমূল ধারণা ও বিজ্ঞানের মধ্যে অনৈক্য থাকলেও আধুনিক বিজ্ঞান ও মানব-ধর্মের বা মানবতাবাদের মধ্যে বিশেষ কোন অসঙ্গতি নেই। তাই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধর্মের চেয়ে লোকরীতিই মানুষের আচরণকে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ করে। সামাজিক লোকরীতি দ্বারা সমর্থিত অনেক বিষয় ধর্মের দ্বারাও স্বীকৃত হয়। ‘সমাজে যখন যে লোকরীতি স্বীকৃত, সেটাই প্রচলিত ধর্মমত দ্বারা অনুমোদিত হয়’ (কোনিগ)। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশে সংস্কৃতির বিবর্তন ও পরিবর্তনে এ সত্য বরাবরই স্পষ্ট হয়েছে যে, কোন বিশেষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা অথবা বিজেতা ও বিজিতের তথা শাসক ও শাসিতের স্নায়ুবিক দ্বন্দ্বের ধারায় নয় বরং দল-মত, ধর্ম-বিশ্বাস নির্ভর বৈশিষ্ট্যের মাধুর্যের বিনিময়ে অভূতপূর্ব আত্মপ্রত্যয়ী মন-মননের স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ও আত্ম বিকাশের ধারাবাহিকতায় এ সংস্কৃতি প্রসার লাভ করেছে। বঙ্গীয় এলাকায় আর্য বর্ণ-হিন্দু ও সনাতনী-হিন্দু এবং নব্য মুসলমানরা স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার সবটাতে বাঙালিত্ব অর্জন ও তা অব্যাহত রাখার সকল প্রয়াস গ্রহণ করেছিল। এভাবে বহিরাগত ও ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং সনাতনী হিন্দুদের অসাম্প্রদায়িক সম্মিলন অনবদ্য সমন্বিত দর্শনের আলোকে এ অঞ্চলে এক নতুন জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায়। এই নতুন দর্শনের অন্তর্নিহিত শক্তি হলো- দেশ, দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ দাবিদার হওয়া এবং এর উন্নয়নে যথোপযুক্ত অবদান নিশ্চিত করা। এ অঞ্চলের সমগ্র মানবগোষ্ঠীর প্রকৃত উপলব্ধি হলো- এই দেশ আমার; এই ভাষা-সংস্কৃতি-লোকাচার-কৃষ্টি সবটাই আমার। আমি এই দেশের বাঙালী সন্তান এবং ধর্ম বিশ্বাসে কেউ হিন্দু- কেউ মুসলমান। কেউবা বৌদ্ধ- কেউবা খ্রীস্টান। ধারাবাহিক প্রাণবন্ত পরিক্রমায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত বাঙালী সংস্কৃতির প্রসারে একদিকে যেমন প্রত্যন্ত গ্রামে লাইলী-মজনু, ইফসুফ-জুলেখা, ইমাম বিজয়, রসুল বিজয়, আলিফ-লায়লা, হানিফা-কয়রাপরী, দাস্তান-ই-আমীর হামজা, সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামান প্রভৃতি আরবী ও ফারসী কাহিনীভিত্তিক পুঁথি সাহিত্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, ঠিক তেমনিভাবে চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, চৌতিশা, বিদ্যাসুন্দর, মনসা মঞ্জিল, সোনাভান, জ্ঞান সাগর, জ্ঞান প্রদীপ, যোগ কলন্দর, কাফনচোর, পদ্মাবতী, মধুমালতী, মৃগাবতী, সতীময়না ও চন্দায়ণ প্রভৃতি কাব্য কাহিনীও গণমানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। জাতিগতভাবে বাঙালী ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান হয়ে দলবেঁধে মসজিদ-মন্দির-গির্জায় যাওয়া, যে যার ধর্ম মত উপাসনা করা, মুসলমানদের মিলাদ পড়া, রোজা রাখা, জানাজায় শরিক হওয়া, পীরের দরগাহ মানত করা, কবর জেয়ারত, জেয়াফত করা, মুরুব্বিদের আশীর্বাদ নেয়ার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রক্রিয়া যেমন সচল রয়েছে, তেমনি অমর একুশে, স্বাধীনতা, বিজয় দিবস উদ্যাপন, পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদ্যাপন, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তজয়ন্তী উদ্যাপন, নববর্ষে হালখাতা, বসন্তের আগমনে কপালে টিপ দিয়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা, কবিতা-ছড়া পাঠের আসর, পিঠা উৎসব, উৎসব পার্বণে আলপনা আঁকা, বিয়ের অনুষ্ঠানে গায়ে হলুদ ও গান বাজনা, বধূবরণ, চৈত্র সংক্রান্তি, পূজা-মেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রভদে সর্বজনীন মানবতায় উজ্জীবিত সংস্কৃতিই বাংলাদেশের এবং বাঙালী সংস্কৃতি। হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কে টানাপোড়েনের মাঝেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক নয়, বরং ভাষাভিত্তিক জাতীয়াবাদের প্রজ্বলন ঘটিয়ে অন্ধকারের অদৃশ্য শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে নিধন করে সকলের ঐক্যবদ্ধতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সুনামগঞ্জের সভায় বঙ্গবন্ধু অতি আবেগী ভাষণে বলেছেন, ‘এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান আপনারা সুখে বাস করবেন। পাশাপাশি বাস করবেন। ভাই ভাই বাস করবেন। কোন মতে যেন সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মাটিতে আর না হয়। তাহলে আমি হার্টফেল করে মারা যাব। কারণ, জীবন ভরে আমি সংগ্রাম করেছি মানুষের মঙ্গলের জন্য।’ সকলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ ছিল, সাম্প্রদায়িকতার বীজ যেন বাংলার মাটিতে বপন ও ফলশ্রুতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা কষ্টপীড়িত না হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার এই সময়কালে সকল ভয়কে জয় করে করোনা মুক্তির প্রার্থনা এবং বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জীবনযাপন আনন্দ-সত্য-মঙ্গল ও কল্যাণময় হোক- এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সকলের প্রতি শারদীয় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×