কুমিল্লা নগরীর একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননার খবর ছড়িয়ে কুমিল্লাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে সহিংস ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে, যা অনাকাক্সিক্ষত ও উদ্বেগজনক। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বুধবার রাত ১১টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার বিকেলে এ সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত দুর্গাপূজা উপলক্ষে নিরাপত্তার স্বার্থে দেশের বাইশটি জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। দেশবাসী আশ্বস্ত বোধ করছে যে, কুমিল্লার ঘটনায় সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাউকে আইন হাতে তুলে না নেয়ার ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। বিগত বিভিন্ন বছরে রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী, গঙ্গাচড়ার ঠাকুরপাড়া গ্রাম, সুনামগঞ্জের শাল্লায় মন্দির এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা যে ‘ছকে’ ঘটেছিল, কুমিল্লার ঘটনাও এরই ভিন্নধর্মী ও ভয়ঙ্কর পুনরাবৃত্তি বলেই প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
হাজার বছর ধরে নানা জাতি-ধর্মের মানুষ এই ভূখণ্ডে শান্তিপূর্ণভাবে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এ দেশের সুমহান ঐতিহ্য। বাংলাদেশের প্রাথমিক পরিচিতি মূলত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে। এ দেশের মানুষ নিজ নিজ ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে তারা অনুকরণীয় আদর্শ বলে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক বলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতার আদর্শ এ দেশে বিদ্যমান। দেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও বকধার্মিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীনদের কারণে কখনও কখনও তাদের সুনামও কণ্টকিত হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে সম্মিলিতভাবে অটুট রাখতে হবে। ইসলাম বিশ্ব মানবতার ধর্ম, কল্যাণ ও শান্তির ধর্ম। এ ধর্ম কখনই অন্য ধর্মের উপাসনালয় কিংবা বাড়িঘরে হামলা করার অনুমোদন দেয় না। বরং ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সারাদেশের প্রশাসনকে সা¤প্রদায়িক অপশক্তির উস্কানিমূলক তৎপরতা ও ষড়যন্ত্রমূলক দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলা প্রয়োজন, সাময়িকভাবে উত্তেজনা ছড়িয়ে লাভ হবে না। গুটিকতক দুষ্কৃতকারীর জন্য সম্প্রীতির দেশে কখনই সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে না। দেশবাসী প্রত্যাশা করে- স্বল্প সময়ের মধ্যে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে অপকর্মকারী চক্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়বে। এর নেপথ্যে যদি কোন বড় নাশকতার পরিকল্পনা থেকে থাকে, মানুষের ধর্মানুভ‚তিতে আঘাত হেনে সুকৌশলে শান্তি-সম্প্রীতিময় পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চক্রান্ত থাকে, তাহলে সেটিও উদ্ঘাটিত হবে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ সরকার ফেসবুকের কাছে প্রায় চার শ’ এ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়ে আসছে। সরকারের শতকরা ৪৪ শতাংশ অনুরোধেই ফেসবুক সাড়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অন্তত ছয়টি জঙ্গী সংগঠন ও এক ব্যক্তিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ফেসবুক। জঙ্গী সংগঠনগুলো হচ্ছে আল মুরসালাত মিডিয়া, ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ, হরকত উল-জিহাদ-ই-ইসলামী বাংলাদেশ, আনসার উল্লাহ বাংলা টিম, জামায়াত উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও সাহাম আল-হিন্দ মিডিয়া। এগুলোর প্রতিটিরই এদেশে বিবিধ অপকর্মের উদাহরণ রয়েছে। কুমিল্লায় ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের চক্রান্তকারীদের সঙ্গে ফেসবুকে কালো তালিকাভুক্ত কোন জঙ্গী সংগঠনের যোগসাজশ আছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
আমরা আবারও বলতে চাই, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক ও অশুভ শক্তিকে পরাভ‚ত করেই স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর রক্তস্নাত এ দেশে তাদের কালো ছায়া কোনভাবেই আমরা দেখতে চাই না।
শীর্ষ সংবাদ: