ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিল্টন বিশ্বাস

শিশুদের প্রতি শেখ হাসিনার মমত্ববোধ

প্রকাশিত: ২১:২১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

শিশুদের প্রতি শেখ হাসিনার মমত্ববোধ

রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা আজ সকলের নেত্রী, বিশ্বের অহঙ্কার। তিনি অসহায় মানুষের ঠিকানা। সকল শিশু তাঁর কাছে ছোট্ট সোনামণি। নিজের এক পুত্র এক কন্যাসহ তাঁর রয়েছে ৭ জন নাতি-নাতনি। শিশুদের সঙ্গেই শেখ হাসিনার পারিবারিক জীবন অতিবাহিত হয়। গত বছর (২০২০) ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে শুরু হওয়া ‘মুজিববর্ষে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের শিশুদের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। ‘মুজিববর্ষ’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘শিশুদের কাছে শেখ হাসিনার চিঠি’ শিরোনামে সেই পত্রটি শ্রেষ্ঠ কথামালা। এরপর বিভিন্ন সালে ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে প্রদান করা ভাষণগুলোও গুরুত্বপূর্ণ শিশুভাবনা। অধিকন্তু ২৬ মার্চের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস তথা জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশ এবং অক্টোবর মাসের বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে শেখ হাসিনার নির্বাচিত ভাষণ সঙ্কলিত হয়েছে যেখানে তাঁর শিশুভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া একাধিক ভাষণে শিশুদের সম্পর্কে বলা কথাগুলো চিন্তার স্ফুলিঙ্গ। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। এজন্য তাঁর জন্মদিন ১৭ মার্চকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ‘জাতীয় শিশু দিবস’ ঘোষণা করেন। দিবসটির তাৎপর্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জড়িত। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। জাতির পিতার জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এইদিনে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে মহান নেতার জীবন ও আদর্শ অনুসরণে এ দেশের শিশুদের যথাযোগ্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই বর্তমান সরকারের মুখ্য লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক উদ্ধৃত করে সব সময় ছোটদের আদর্শবাদী হতে বলেন। তাঁর মতে, আজকে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার শপথ নিতে হবে। শপথ নিতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার। ২০২১ সালের শিশু দিবসের বাণী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব শিশুদের কল্যাণে বর্তমানকে উৎসর্গ করতে সবার প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। ২০২০ সালেও তিনি বলেছিলেন, ‘সব শিশুর সমঅধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাবা-মা, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ এবং সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’ ২০২০ সালের জাতীয় শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘মুজিববর্ষে সোনার বাংলা, ছড়ায় নতুন স্বপ্নাবেশ; শিশুর হাসি আনবে বয়ে আলোর পরিবেশ।’ জাতির পিতার জীবন ও কর্ম আপামর জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৫ মার্চ ২০২১ সময়কে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ইউনেস্কোর উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ‘মুজিববর্ষ’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন ও প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন। বর্তমান সরকার উন্নয়ন ও সুরক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জাতীয় শিশু নীতি-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ প্রণয়ন করেছে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার প্রিয় মাতৃভূমিকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। গত এক দশক যাবত শিক্ষার্থীদের বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া শিশুদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করে তাদের ব্যক্তিত্ব গঠন, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার বিভিন্ন শাখায় শিশুদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের যে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসেন তার দৃষ্টান্ত ভাষণগুলোতে ছড়িয়ে আছে। আবার ২০১৬ সালে পটুয়াখালী সরকারী জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শীর্ষেন্দু বিশ্বাসকে চিঠির জবাব দিয়ে বিস্ময় উদ্রেক করেছেন তিনি। ২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শীর্ষেন্দুর স্কুলে পৌঁছানো প্রধানমন্ত্রীর চিঠিটি ছিল এরকম- ‘স্নেহের শীর্ষেন্দু, আমার স্নেহাশীষ নিও। তোমার চিঠি পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তুমি শুধু এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক নও বরং দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার অগ্রজ সৈনিক। আমি জানি, পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার পায়রা নদীটি অত্যন্ত খর¯্রােতা। নিজের পিতা-মাতাসহ অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই নদীকেন্দ্রিক তোমার নিরাপত্তা সচেতনতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি বুঝতে পারি তোমার বীর মুক্তিযোদ্ধা দাদুর প্রভাব রয়েছে তোমার ওপর। মির্জাগঞ্জের পায়রা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তোমাকে আশ্বস্ত করছি। তোমার সার্বিক মঙ্গল কামনা করি। আমার দোয়া নিও। তোমার বাবা-মাসহ মুরুব্বিদের সালাম ও ছোটদের দোয়া দিও। অনেক অনেক আদর নিও।’ -শেখ হাসিনা এর আগে ২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট তিন পৃষ্ঠার চিঠিতে শীর্ষেন্দু লিখেছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সালাম ও শুভেচ্ছা নেবেন। আমি একজন সাধারণ নাগরিক। আমার নাম শীর্ষেন্দু বিশ্বাস। পিতা বিশ্বজিৎ বিশ্বাস, মা শীলা রানী। আমি পটুয়াখালী সরকারী জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর একজন নিয়মিত ছাত্র। আমার দাদু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নাম অবিনাশ বিশ্বাস। আমার মা সরকারী চাকরি করেন। আমি আপনার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে আপনার পিতার শৈশবকাল নিয়ে রচনা লিখে তৃতীয় স্থান অধিকার করি। আমাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে। আমাদের মির্জাগঞ্জ পায়রা নদী পার হয়ে যেতে হয়। এটি পটুয়াখালীর একটি উপজেলা। এ নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ। মানুষ ভয় পায়। কখনও কখনও নৌকা ডুবে যায়। আমার ছোট ভাইবোন তাদের মা-বাবাকে হারায়। তাই আমি চাই না কারও মা-বাবা চলে যান। আমি আমার মা-বাবাকে প্রচণ্ড ভালবাসি। তাঁদের হারাতে চাই না। তাই আপনার কাছে একটাই অনুরোধ যে, আপনি মির্জাগঞ্জ পায়রা নদীর ওপর ব্রিজের ব্যবস্থা করুন। তা যদি আপনি পারেন তা হলে একটু আমাদের জন্য কষ্ট করে এই ব্রিজ তৈরি করার ব্যবস্থা করুন। আজ আর নয়। ইতি আপনার দেশের একজন সাধারণ নাগরিক।’- শীর্ষেন্দু বিশ্বাস। এদেশের স্কুলের একজন শিশুর প্রতি মমত্ববোধ নিংড়ানো প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠিতে আরও ছিল শীর্ষেন্দুর মতো শিশুরা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার অগ্রজ সৈনিক। চিঠির জগতের মতোই তাঁর অফিসিয়াল ভাষণগুলোও আন্তরিকতায় পূর্ণ। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ভিডিওকল দিয়ে অটিস্টিক শিশু রায়ার ইচ্ছা পূরণ করেন। রায়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করেন বলে তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে এক ভিডিও বার্তা পোস্ট করলে শিশুটির ভালবাসায় সাড়া দিয়ে তিনি নিজেই রায়াকে ভিডিওকল করেন এবং তার সঙ্গে কথা বলেন। সে সময় রায়ার কবিতা শোনেন এবং শিশুটির সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছেন শেখ হাসিনা। প্রকৃতপক্ষে ছোটদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গভীর স্নেহ ও হৃদয় নিঃসৃত অনুকম্পা প্রকাশ হয়েছে তাঁর আনুষ্ঠানিক ভাষণ, বাস্তবসম্মত কর্মসূচী ও ব্যক্তিগত আচরণের মধ্য দিয়ে। শিশু সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরও মন্তব্য- ক) আসুন আমাদের বর্তমানকে এই শিশুদের জন্য উৎসর্গ করি। তারা যেন উন্নত মানুষ হিসেবে বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। খ) ছোট্ট বন্ধুরা, রাসেলের বোন হিসেবে, তোমাদের প্রিয় বোন হিসেবে, আমি কথা দিচ্ছি, আমি সব সময় তোমাদের পাশে থাকব। গ) জাতির পিতা শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছিলেন। শিশুদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেছিলেন। আমরা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই শিশুদের কল্যাণে কাজ করছি। ২০১১ সালে আমরা জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করেছি। ঘ) পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ও বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। কারাগারে আটক শিশুদের সংশোধন ও পুনর্বাসন করার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সারাদেশের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে শিশুদের জন্য কিডস্ কর্নার ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ঙ) শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। শিশুমৃত্যু হার হ্রাস ও শিশুস্বাস্থ্য রক্ষায় সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা এমজিডি এ্যাওয়ার্ড ও সাউথ সাউথ এ্যাওয়ার্ড লাভ করেছি। শেখ হাসিনার মতে আজকে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার শপথ নিতে হবে। শপথ নিতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার। আর এজন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×