ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশকে ভালবাসতে হলে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে

প্রকাশিত: ২০:১১, ৩ আগস্ট ২০২১

বাংলাদেশকে ভালবাসতে হলে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সুপ্রীমকোর্টের ফুলকোর্ট সভায় আমার বক্তব্য: মাননীয় প্রধান বিচারপতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে ২ মিনিটে কথা বলা যায় না, কারণ আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারপতি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ২১ বছরকাল নতুন প্রজন্মের কাছে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি তারা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে চায়। এ প্রসঙ্গে তিনি আপীল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী, বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামানকে সহযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আমরা জাতির পিতার নির্দেশে এবং তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। হঠাৎ কারও হুইসেলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত উপমহাদেশ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্তির পর দুই হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পৃথক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দুটি ভূখ-ের সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান নামক অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের জন্ম হলেও প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন হয়নি, তা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু তরুণ নেতা হিসেবে গোড়া থেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। এরই প্রেক্ষিতে তিনি এ অঞ্চলে বাঙালী জনগণের স্বার্থে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, যার ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬ দফার ভিত্তিতে স্বাধীকার আন্দোলন, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের পথ ধরে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৬ মার্চ ধানম-ির ৩২ নং সড়কের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মতে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যসহ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। একই সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান) পাঠ ও অনুমোদনের মাধ্যমে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭৫ পরবর্তী সুদীর্ঘ ২১ বছরকাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহির্ভূত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস পাল্টে দিয়ে বিকৃত করে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আপনার প্রতি আমাদের অনেক কৃতজ্ঞতা কারণ বাংলাদেশের জন্মের সুদীর্ঘ ৫০ বছরকাল অতিবাহিত হলেও জাতির এই আশ্রয়স্থল সুপ্রীমকোর্টের ফুলকোর্ট সভায় এই প্রথমবারের মতো আপনার উদ্যোগে জাতির পিতার জীবনালেখ্য নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। আপনি জানেন, সারা দুনিয়ার মানুষ বিশেষ করে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে যারা স্বাধীনতা লাভ করেছে তারা নিজের জন্মের ইতিহাস এবং জাতির পিতাকে কখনও বিতর্কিত করার ঔদ্ধত্য দেখায়নি, আমেরিকায় তাদের ইতিহাসের বিরুদ্ধে কথা বললে সে যেই হোক না কেন, রাজনীতি করা তো দূরে থাক, তার দেশে থাকার অধিকার থাকে না। এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তানেও জাতির পিতার প্রশ্নে তাদের কোন বিভেদ নেই। আমরা অভাগা জাতি, এখানে এক শ্রেণীর ক্ষমতালোভী ও জ্ঞানপাপী মানুষ আছে যারা সবকিছু নিয়েই বিতর্ক করতে চায়। তারা নিজের জন্মের পরিচয় নিয়ে বিতর্ক করে। তাদের অধম ছাড়া আর কি বলা যায় আমার জানা নেই। আমাদের যা কিছু অর্জন তা রাজনৈতিক নেতৃত্বেই হয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ৬ দফার ভিত্তিতে ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি এসব কিছুর পেছনেই ছিল জাতির পিতার দক্ষ ও সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ২৩ বছরকাল পাকিস্তানী উপনিবেশের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে উপহার দিয়েছেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে পাকিস্তানী দোসররা ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রক্ষমতা। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সততা ও দক্ষতার কারণেই বাংলাদেশের উল্টো পথের যাত্রাকে সোজা পথে এনে সামনের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। জাতির পিতার সঙ্গে একাধিকবার আমার সাক্ষাত ও নিকট থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্তির পর কুষ্টিয়া সফরকালে, ’৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে কুষ্টিয়ার জনসভায়, ’৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সময়, ’৭৩ সালে ধানম-ির ৩২ নং রোডের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর সান্নিধ্যে গেলে স্বভাবসুলভভাবেই তিনি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ৭ দিন রোজা রেখেছি। ১০ জানুয়ারি ’৭২-এ রোজা রেখেই কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা এসেছিলাম। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর নির্বাসিত জীবন শেষে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফেরার দিন ঢাকা এসেছিলাম তাকে স্বাগত জানাতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার ঢাকা আগমনে সেদিন প্রকৃতি অঝরে কেঁদেছিল। প্রকৃতির কান্নার সঙ্গে লাখো জনতার চোখের পানি একাকার হয়েছিল। এসব অনেক স্মৃতি অল্প কথায় বলে শেষ করা যায় না। জাতির পিতাকে নিয়ে অসংখ্য লেখা এবং গবেষণা আছে। তিনি নিজেও তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছেন। আমি আজ থেকে ৯ বছর পূর্বে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী সুপ্রীমকোর্টের সকল মাননীয় বিচারপতির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে হলে তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ গবেষিত পুস্তক পাঠ করতে হবে। বাংলাদেশকে ভালবাসতে হলে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের নির্মোহভাবে কাজ করতে হবে। সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। লেখক : বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
×