ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বহুরূপী প্রতারক তরুণী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ২ আগস্ট ২০২১

বহুরূপী প্রতারক তরুণী গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রয়োজন মতো স্থান, কাল, পাত্রভেদে পাল্টে যায় পরিচয়। কখনও তিনি তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী, কখনও গবেষক, আবার কখনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক- এমন অসংখ্য ভুয়া পরিচয়ে পরিচিত ইশরাত রফিক ঈশিতা। এর বাইরে নিজেকে ডিপ্লোম্যাট কিংবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পরিচয়ও দিতেন তিনি। সুবিধামতো বিশিষ্ট আলোচক পরিচয় দিলেও আদতে তার প্রধান উদ্দেশ্য প্রতারণা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশী ও বিদেশী সংস্থার ভুয়া প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে নানাবিধ প্রতারণা অভিযোগে তাকে আটক করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। শনিবার রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। এ সময় তার সহযোগী মোঃ শহীদুল ইসলাম দিদারকেও গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব জানায়, ময়মনসিংহের একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-০৬) এমবিবিএস সম্পন্ন করে ২০১৪ সালে মিরপুরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে যোগদান করেন তিনি। চার মাস চাকরি না করতেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন উচ্চাভিলাষী তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক ওরফে বিশিষ্ট আলোচক ওরফে ডিপ্লোম্যাট ওরফে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওরফে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা। এরপরই শুরু তার বহুমুখী প্রতারণা। গ্রেফতার ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র‌্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় ‘ব্রিগেডিযার জেনারেল’ পদটি গ্রহণ করেন। যার সত্যতা ও যথার্থতা পাওয়া যায়নি। এছাডাও তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সংগঠনে পদে সনদপ্রাপ্ত বলে ভুয়া প্রচার চালিয়েছেন। নিজেকে চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। এমপিএইচ, এমডি, ডিওসহ নানা ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী ব্যবহার শুরু করেন। ভুযা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। এজন্য বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল বা থিসিসের ভুয়া প্রকাশনাও ব্যবহার করেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবেও পরিচয় দেন। করোনাকালেও থামেনি তার প্রতারণা। দুই দফায় ৬০ চিকিৎসককে তিনি সেমিনারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেন ও সার্টিফিকেট প্রদান করেন। শেষমেশ ধোপে টেকেনি তার বহুমুখী প্রতারণা। এ বিষয়ে রবিবার বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েদা শাখা ও র‌্যাব-৪-এর অভিযানে রবিবার সকালে রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন মিরপুর-১ থেকে ঈশিতাকে (৩৪) সহযোগী শহিদুল ইসলাম ওরফে দিদারসহ (২৯) গ্রেফতার করা হয়। ঈশিতার বাবার নাম খন্দকার রফিকুল ইসলাম। ঢাকার কাফরুলে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। অভিযানে ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০ পিস ইয়াবা, ৫ বোতল বিদেশী মদ ও মোবাইল উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে ও গোয়েন্দা অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার ইশরাত রফিক ঈশিতা পেশায় একজন চিকিৎসক। যিনি বিভিন্ন মাধ্যমে একজন আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডি সম্পন্ন, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদা এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভুয়া পরিচয় প্রদান করে আসছিলেন। ভুয়া পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তিনি ভুয়া নথিপত্র তৈরি ও প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ হতে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালে মিরপুরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। চার মাস পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত হন। গ্রেফতার ইশরাত রফিক ঈশিতা চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী এমপিএইচ, এমডি, ডিও সব তার ভুয়া। ভুয়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তিনি প্রচার করতেন। বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল বা থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন মর্মে প্রচার করতেন। গ্রেফতার ঈশিতা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদেশে প্রাপ্ত ভুয়া সাফল্য স্বীকৃতের প্রচার করতেন। ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক এ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশন প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে ‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’ হিসেবে পুরস্কার। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ এ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম এ্যাওয়ার্ড ২০২০’, থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট এ্যান্ড রিসার্চার এ্যাওয়ার্ড’, যদিও এর সবই ভুয়া। শুধু তাই নয়, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন বলে প্রচার করতেন। প্রচার করতেন, তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এছাড়াও তিনি এ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন যথাক্রমে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ এ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুড উইল ইত্যাদি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তার এসব এ্যাওয়ার্ড ও অনুষ্ঠানে উপস্থিতির ছবি এডিটিং করে গণমাধ্যমে প্রেরণ ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচার করতেন। র‌্যাব জানায়, ঈশিতা করোনা মহামারীকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণা সক্রিয় ছিলেন। আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান এবং প্রচার চালিয়েছেন। তিন/চার হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি দুই দফায় ৬০ চিকিৎসককে করোনা চিকিৎসার প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেট প্রদান করেন। বিদেশীদের ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে প্রচার চালিয়ে আগ্রহীদের অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি ও আকৃষ্ট করতেন। ঈশিতা ‘ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফর হিউম্যানিটি’ নামক একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনা করতেন এই প্রতারণার জন্য। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যার ফেসবুক পেজ ও লিঙ্কডইন আইডি রয়েছে। সংস্থাটির সদর-দফতর নিউইয়র্কে বলেও প্রচার করতেন তিনি। এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতারণার নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়। প্রতারণার অংশ হিসেবে তিনি নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন। এ দেশগুলোকে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার এ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে প্রচার করতেন তিনি। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
×