ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কান্তি মজুমদার

কর্মযোগী বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়

প্রকাশিত: ২০:২৯, ২ আগস্ট ২০২১

কর্মযোগী বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়

২ আগস্ট। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের এদিনে বর্তমান খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাড়ুলী গ্রামে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যিনি স্যার পিসি রায় নামে সমধিক পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী প্রফুল্ল চন্দ্র ৯ বছর পর্যন্ত নিজ গ্রামে তার পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মিডল ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে কলকাতা গমন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) বিএ পড়াকালে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি নিয়ে বিলাত গমন এবং এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রী অর্জন করে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মাসিক ২৫০ টাকা বেতনে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। রসায়ন শাস্ত্রের এ অধ্যাপক ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মারকিউরাস নাইট্রাইটস নামক যৌগিক পদার্থ আবিষ্কার করেন। নাইট্রাইটসের ওপর বহুবিধ গবেষণা ও সাফল্যের জন্য তাকে মাস্টার্স অব নাইট্রাইটস বলা হতো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথা রবির প্রখর আলোকচ্ছটায় যখন ভারতবর্ষ উদ্ভাসিত, তখন জোছনার প্রদীপ্ত আলোর ন্যায় স্বীয় প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রফুল্ল চন্দ্র করেছেন বিভিন্ন দিককে আলোকিত। তিনি হয়েছেন প্রবাদপ্রতিম রসায়নবিদ, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী, বিজ্ঞানসেবী, সাহিত্যবোদ্ধা, স্বদেশী আন্দোলনকারী, ধর্ম সংস্কারক, শিল্পোদ্যোক্তা, সমবায়ী, ফলিত অর্থনীতিবিদ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মী, আর্তসেবী, মানবদরদী, ইতিহাসবিদ এবং কর্মযোগী। এতবড় একজন বিজ্ঞানী নিজেই বলেছেন ‘ও নবপধসব ধ পযবসরংঃ নু সরংঃধশব’। বাঙালীর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সাহস তো দূরের কথা, কল্পনা করাও যখন ছিল অতীত। সে সময় বেতনের সঞ্চিত ৮০০ টাকা নিয়ে বসতগৃহে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি করা অবস্থায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল কেমিক্যাল এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করে দেশীয় ও ভেষজ উৎপাদন দিয়ে কেমিক্যাল ও ওষুধ প্রস্তুত শুরু করেন। এদেশে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য বেঙ্গল ইনিসিয়েটিভ নামক আলোচনা সভার প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র প্রমুখ প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিকের যুগে একজন বৈজ্ঞানিকের সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ থাকে না। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। শেক্সপিয়ারের ওপর ধারাবাহিক প্রবন্ধ এবং বই লিখেছেন। একই সঙ্গে সমবায়, কৃষি উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, রসায়ন, ইতিহাস, প্রাণীবিজ্ঞান, সমাজ সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখেছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তিনিই এতদাঞ্চলে পথপ্রদর্শক। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে বাংলায় বই প্রকাশের জন্য ১৮৯০ সালে তিনি নেচার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরপর ৩ বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্প উদ্যোগ, ব্যবসা, সমাজ সংস্কার, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বহু বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ রচনা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রসারে ভূমিকা রাখেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় শুরুর থেকে তিন দশকের বেশি সময় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখেছেন। এ পত্রিকায় শেষ লেখা যখন বের হয় তখন তার বয়স ৭৫। অথচ এ বয়সে তার লেখার বিষয় ছিল ‘অন্ন সমস্যা ও গো-পালন’। প্রয়াত শিক্ষকদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য সমবায় মডেলে তিনি ‘টিচার্স বেনেভোলেন্ট ফান্ড’ গঠন করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ অর্গানাইজেশন সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার দুর্গম অঞ্চলে সমবায় ব্যাংক উদ্বোধনের জন্য ৭২ বছর বয়সে সারারাত হাতির পিঠে চেপে গমন করেন। দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কারণে দুস্থ পরিবারকে রক্ষার জন্য ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন আর্য বীমা কোম্পানি। ১৯৩৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বীমা সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশীয় বীমা কোম্পানি এবং এর গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য বীমা আইনে এ বিষয়ে ধারা সংযোজনে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। আচার্যের সক্রিয় রাজনীতি করার সময় ও সুযোগ কোনটাই ছিল না। অথচ ১৮৮৫ সালে বিলেতে থাকা অবস্থায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে ‘India before and after Muti’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা করেন। ইংরেজ গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় তার সম্পর্কে রিপোর্ট ছিল ‘Revolutionary in the disguise of Scientist।’ স্বদেশী আন্দোলন করেছেন। ব্রিটিশ রাজের ভারতবিরোধী নীতির সমালোচনা করেন। মঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় আচার্য সম্পর্কে লেখা হয় ‘He is one of the bitterest critics of the British Govt।’ তার বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে- ‘Science can afford to wait but Swaraj can not।’ শিক্ষক এবং শিক্ষা সম্প্রসারণে তার তুলনা তিনি নিজে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে National Council of Education-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরিকালে ‘The Congress of the Universities of the Empire-এ যোগদানের জন্য ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং ভারতে আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি পেশ করেন। নিজ গ্রামে ১৯০৩ সালে পিতার নামে উচ্চ ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘All Bengal Teachers Association (ABTA)-এর প্রথম সম্মেলনেরও সভাপতি। তিনি All India Education Conference আয়োজন করেন। All India College and Universities Teachers Conference-এর উদ্যোক্তা ও সভাপতি ছিলেন তিনি। নারী শিক্ষা ও ভকেশনাল শিক্ষা সম্প্রসারণে আর্থিক সহযোগিতা করেন। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তিনি Indian Science Nwe Association গঠন করে এর প্রথম সভাপতি হন। বাগেরহাটে কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন, যা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তার নামে নামকরণ করা হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি কুখ্যাত মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের বিরোধিতা করেন। বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বাত্মক সহযোগিতার পাশাপাশি নিজে ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নিতেন। আর্তত্রাণে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে মহাত্মা গান্ধী তাকে Doctor of Floods সম্বোধনে অভিহিত করেন। তিনি সমাজের বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতা নিবারণ এবং সমাজ সংস্কারে সমিতি গঠন করেন। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় মেথরকে জড়িয়ে ধরেন। জাতিভেদ, শিশুবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন করেন তিনি। তিনি এজন্য কমিটি করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন, ট্রাস্ট গঠন করেছেন। তার কোন ভৃত্য ছিল না। তার খাবার ছিল অতিসাধারণ। তিনি দিনের বেলা ভাত খেতেন না। কারণ দিনে ভাত খেলে ঘুম পাবে এবং কাজের সময় কমে যাবে। তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল লেখা বই-এর রয়ালটি এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের বেতন সব মিলিয়ে মাসে তার প্রচুর আয় ছিল। কিন্তু তার ব্যয় ছিল মাসিক ১৬ টাকা তথা দৈনিক আট আনা। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসরের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এ সময় তিনি বেতন গ্রহণ করেননি। তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়ার সময় বেতন বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে তার সঞ্চিত অর্থ প্রায় ১০ লাখ টাকা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার এরূপ দানের ঘটনা অনেক। বাগেরহাট পিসি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও খাদি সম্প্রসারণ, সমবায় সম্প্রসারণ, বন্যা ত্রাণ, নারীশিক্ষা, সমাজ সংস্কারসহ বহুবিধ উন্নয়নে তার উল্লেখযোগ্য দান আছে। কর্মযোগী জ্ঞানতাপস এ বিজ্ঞানীর ৭০তম জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে। এ আয়োজনের জন্য সংগৃহীত হয় ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু খরচ হয়েছিল মাত্র ১২৭ টাকা। অবশিষ্ট টাকা তিনি দান করেছেন। মানবদরদী এ বিজ্ঞানীর জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল তৈরি, হ্যান্ড বিল বা অন্যান্য বিষয়ে অনেক সরবরাহকারী টাকা গ্রহণ করেননি। এটাই তার কাজের স্বীকৃতি। বেতনের টাকা দিয়ে তিনি বিজ্ঞান কলেজের জন্য ৬টি ঘর তৈরি করেন তিনি। শর্ত একটি ঘরে তাকে আজীবন থাকতে দিতে হবে। নাইট উপাধী অর্জনকারী অকৃতদার এ বীর বাঙালী তার সর্বস্ব দান করে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন পরলোক গমন করেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার প্রচেষ্টা, কাজ ও অর্জন এখন বহুগুণে সম্প্রসারিত হয়েছে। আজ ২ আগস্ট বাংলাদেশের এ মহান বিজ্ঞানীর শুভ জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই। লেখক : সাবেক সচিব
×