ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

রক্তাক্ত মাতৃভাষা বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা-১০

প্রকাশিত: ২০:০৭, ২ আগস্ট ২০২১

রক্তাক্ত মাতৃভাষা বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা-১০

এর আগে সুদীর্ঘ আলোচনায় আমরা বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলেছি। আগের মোট নয়টি পর্বের আলোচনায় আমরা একদিকে মাতৃভাষার জন্য সারা দুনিয়ার লড়াই এমনকি বাংলা ভাষার জন্য ভারতের অসমে রক্তদান ও উপমহাদেশের ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দেশের মাতৃভাষা আন্দোলন নিয়েও কথা বলেছি। এই পর্বে আমরা রক্তে ভেজা বাংলা ভাষার উপসংহারে পৌঁছাতে চাই। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সাময়িক বিজয়ের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ছেড়ে যাননি। তাই ভাষা আন্দোলনের পূর্ণ সফলতার পর্বে তার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি কত কঠোর ছিল, তার নমুনা বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক রাজনৈতিক ব্যক্তি অথবা ভয়ানক শত্রু। বস্তুত পাকিস্তানের জন্মের পরপরই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকা- পাকিস্তানীদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে এই মানুষটি যেনতেন একজন রাজনীতিক নন, এমন একজন কমিটেড রাজনীতিক যার নীতি ও আদর্শ আপোসযোগ্য নয়। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে যে কর্মসূচী নেয় হয় তা পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশ দেন। ওইদিন সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহরে টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘এটা আমাদের ভাষার দাবি নয়, এটা আমাদের বাঁচার দাবি।’ তাঁর অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা প্রথম গানটি ‘ভুলবো না’ পরিবেশন করেন। সভায় অন্যান্য স্লোগানের মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ ইত্যাদি এবং চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি উত্থাপন করা হয়। রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। তার এ বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়ে তাকে কালো পতাকা দেখায়। আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি কবিতা আকারে লিফলেটে প্রকাশিত হয়। মুসলিম লীগ বিরোধী মানসিকতা গণমানুষের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী মুসলিম লীগ দ্রুত জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালের গোড়ার দিকে সকল বিরোধী দল নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের কথা আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। অতঃপর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করা, এর প্রতি সম্মান জানানো, শহীদ মিনার স্থাপন করা, বাংলা ভাষার মর্যাদা দান, বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর করাসহ ২১ দফা প্রণয়ন করে এবং এটি দ্রুত জনগণের কাছে সমাদৃত হয়। জনগণ এটিকে পূর্ব বাংলার ‘মুক্তিসনদ’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট যাতে আর কোন সুযোগ না পায় সেজন্য মুসলিম লীগ তাদের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। সেই লক্ষ্যেই শহীদ দিবসের আগে যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে ভাষা সংক্রান্ত সঙ্কট নিরসনে মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির একটি সভা করাচীতে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী, বগুড়া এবং সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। এ সিদ্ধান্তকে বানচাল করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারীরা সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় জনসভা করে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে ফজলুল হকসহ নেতারা জনগণের সঙ্গে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হন। জাতীয়ভাবে নেতৃত্বের অবস্থানে থেকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমি গঠন করে। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন যুক্তফ্রন্ট পুনর্গঠন করা হয়। ১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের সহযোগিতায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার তৈরির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদে কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। দেশব্যাপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ২৯ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচীতে খসড়া শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সরকারকে বলেছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে যদি খসড়া শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উক্ত খসড়া সংবিধানের ওপর বঙ্গবন্ধু জোরালো বক্তব্য রাখেন। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি অবশেষে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান চূড়ান্ত হয় এবং সোহরাওয়ার্দী বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তাতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ নক্শা তৈরি এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে আন্দোলন গড়ে তোলেন সেই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যে কেবল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করা নয়; তার চেয়েও বহুগুণ বেশি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে নয়াচীনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেয়া। হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাকে আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থাপন করার জন্য জাতির পিতার এই প্রচেষ্টা কেবল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার নয় তার চাইতেও হাজার গুণ বেশি গুরুত্ব বহন করে। এই ধারাবাহিকতাতেই জাতির পিতা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও যেসব উদ্যোগ নেন তা অতুলনীয়। এক সময়ে আমরা কেবল একুশে ফেব্রুয়ারিকেই স্মরণ করতাম। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন কেবল আমাদের নয়, সারা দুনিয়ার স্মরণীয় দিনে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখন একুশে ফেব্রুয়ারিই কেবল নয় ১ ফেব্রুয়ারিতে শুরু করে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসকেই আমরা আমাদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা বা সাংবিধানিক ভাষার মাস হিসেবে মেনে চলি। মাসব্যাপী মাতৃভাষাকে স্মরণ করতে দেয়ার কৃতিত্ব¡টা বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলার। শ্রদ্ধা জানাই এই মেলার উদ্ভাবক চিত্তরঞ্জন সাহাকে। একই সঙ্গে সম্মান জানাই ছোট একটি বটতলার মেলাকে সোয়া তিন লাখ বর্গফুটের মেলায় পরিণত করার জন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একই সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদগণ ছাড়াও বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যারা তাদের মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছেন বা দাবি তুলেছেন তাদের সকলের প্রতিই আমাদের পরম শ্রদ্ধা। আমাদের শ্রদ্ধার মাত্রাটি বিস্তৃত হয়েছে- কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, বস্তুত সারাবিশ্ব এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। সারা দুনিয়াকে শ্রদ্ধা যে মাতৃভাষাকে মায়ের সম্মান দিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারা জাতি হিসেবে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি। এজন্য আমাদের শ্রদ্ধা ভারত, আমেরিকা, কানাডা, লাটভিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকান সেই মানুষগুলোর প্রতি যারা তাদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য রক্ত দিয়েছে। আমরা শ্রদ্ধা জানাই অসমের বাঙালীদেরকে, রক্ত দিয়ে ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠা করার জন্য। (সমাপ্ত) ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সর্বশেষ সম্পাদনা ৩০ জুলাই ২০২১ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক [email protected] www.bijoyekushe.net www.bijoydigital.com
×