ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সার্ভে না করেই সনদ প্রদান, সুপারভিশন ও ওভারটাইমের অর্থ গ্রহণ

অনিয়ম দুর্নীতির আখড়া চট্টগ্রামে নৌবাণিজ্য অধিদফতর

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৩ জুন ২০২১

অনিয়ম দুর্নীতির আখড়া চট্টগ্রামে নৌবাণিজ্য অধিদফতর

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে নৌবাণিজ্য অধিদফতর অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সমুদ্রগামী প্রতিটি জাহাজ সরেজমিনে পরিদর্শন করে সার্টিফিকেট ইস্যুর নিয়ম থাকলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। পরিদর্শন ছাড়াই ইস্যু হচ্ছে সার্ভে সার্টিফিকেট। আবার এ নিয়ে সুপারভিশন ও ওভারটাইমের অর্থও হাতিয়ে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত প্রায় দু’বছর ধরে দফতর প্রধানগণ বেশিরভাগ সময় অনুপস্থিত থাকার কারণে সেখানে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজমান। অপরদিকে, মোটা অঙ্কের অর্থের দুর্নীতি যেমন চলমান, তেমনি এক কর্মকর্তা ২০১৭ সালে বেতন ভাতার বাইরে সুপারভিশন ও ওভারটাইম বাবদ পৌনে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমএমও পদের এক কর্মকর্তা ২০১৯ সালে মাত্র কয়েকমাস দায়িত্ব পালন করে জাহাজ সার্ভে না করেও সুপারভিশন দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকারও বেশি অর্থ উঠিয়ে নিয়েছেন। এ ঘটনা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি হওয়ার পর হিসাব শাখা ওই অর্থের হিসাব ও রাজস্ব খাতে কি পরিমাণ জমা হয়েছে তার কোন হিসাব তদন্ত কমিটিকে দেখাতে পারেননি। এখানে উল্লেখ্য, উক্ত পদে কোন কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করলে শুধু দায়িত্বভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু সরকারী নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সার্ভে ও সুপারভিশন খাতে উক্ত পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এসব ঘটনার পর চাঞ্চল্যকর বহু ঘটনা রয়েছে। নৌবাণিজ্য দফতর খুলনার জন্য নিয়োগকৃত ৫ কর্মচারী ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি চট্টগ্রামেই অবস্থান করছেন। ইতোপূর্বে সমুদ্র বাণিজ্য অধিদফতরের দুই মহাপরিচালক ওই ৫ কর্মচারীকে খুলনা অফিসে পাঠানোর পত্র দিলেও তা কার্যকর হয়নি। অথচ, ওই কর্মচারীর অনুপস্থিতির কারণে মংলা বন্দরে আগত জাহাজের পরিদর্শনের অভাবে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দুই কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। নি¤œমান সহকারী পর্যায়ের এক কর্মচারী চট্টগ্রামে এমএমও’র পিএ’র কাজ করেন। এ দফতরের সার্ভেয়াররা কে কোন জাহাজ সার্ভে করবে, পোর্ট স্টেট কন্ট্রোল কিভাবে হবে সবই তার অঙ্গুলি নির্দেশনায় চলে। উল্লেখ্য, এ অফিস সহকারী পিয়ন থেকে পদোন্নতি পেয়ে এ পোস্টে রয়েছেন। দুই ধরনের বয়সের সার্টিফিকেট জালিয়াতির কারণে তার পদোন্নতি দু’বার নাকচ হওয়ার পর তৃতীয় দফায় তার সাফল্য আসে। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সমুদ্র বাণিজ্য দফতরের একজন এ্যাকাউন্টস অবসরে গেলে উক্ত সহকারী একাধারে একাউন্টেট এবং কার্গো ও ফিশিং বোটের রেজিস্ট্রেশনসহ যাবতীয় দেখভাল শুরু করেন। বর্তমানে তিনি দুই ধরনের নৌযানের রেজিস্ট্রার হিসেবে পরিচিত। এসব ঘটনা নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানও চলছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১৬শ’ ফিশিং ও কার্গো বোটের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এসব নৌযানের মূল্য দেড়কোটি টাকার ওপরে হলেও মাত্র ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দেখিয়ে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। ফলে রেজিস্ট্রেশন ফিস ও ভ্যাট আদায়ে সরকার হারিয়েছে এক শ’ কোটি টাকার ওপরে আর লাভবান হয়েছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। বিভিন্ন শিপিং এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে নৌবাণিজ্য দফতরের সার্ভেয়াররা চট্টগ্রাম বন্দরে আগত জাহাজের নিরাপত্তা পরিদর্শনের নামে জাহাজ মাস্টারদের বিভিন্ন হয়রানির মাধ্যমে বিদেশী মুদ্রায় অবৈধভাবে অর্থ আদায় করেছেন, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। লেনদেনে সমঝোতা হলে ওই সব জাহাজের পরিদর্শন হিসাব নথিতে রাখা হয় না। আইএমও নীতিমালা অনুযায়ী কোন বন্দরে আগত বিদেশী জাহাজের পোর্ট স্টেট সার্ভে প্রতিবেদন পাঠানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যত্যয় ঘটে চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে আগত গড়ে ৩ হাজার জাহাজের ৫০ শতাংশ জাহাজ থেকে সরকার দেড়কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
×