ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তোফায়েল হোসেন খান

অভিমত ॥ উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে সঞ্চয়

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১৭ জুন ২০২১

অভিমত ॥ উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে সঞ্চয়

সঞ্চয়ের সমৃদ্ধি। সঞ্চয় বিপদের সঙ্গী। বন্ধুর মতো পাশে এসে দাঁড়ায় সঞ্চয়। আমাদের মা-চাচিরা প্রতিবেলা ভাত রান্নার সময় হাঁড়িতে চাল চাপানোর আগে তা থেকে কিছু চাল রেখে দিতেন। রাখতেন মাটির পাতিলে। ছোট সে পাতিল ভরে গেলে সেই চাল রাখতেন আবার মাটির মটকিতে। জমানো সেই চালকে তারা বলতেন মুষ্টিচাল। জমানো সেই-মুষ্টিচাল যখন ঘরে চাল বাড়ন্ত তথা ভাতের চালের টান পড়ত, তখন তা বেশ কাজে লাগত। লোকের মুখে মুখে তারা পেতেন ল²ীবৌয়ের তকমা। হয়ে উঠতেন একেকজন লক্ষ্মীমন্ত। লক্ষ্মীমন্ত মায়েদের মতো রাষ্ট্রও পারে লক্ষ্মীমন্ত-রাষ্ট্র হতে। আমাদের প্রাণপ্রিয় রাষ্ট্রটি যাতে লক্ষ্মীমন্ত রাষ্ট্র হয়ে ওঠে সে জন্যই কিছু বলা। সরকারও পারে নিয়মিত বার্ষিক বাজেটের একটু একটুখানি আলগা করে আলাদা রেখে দিতে। আলাদা করা সেই সামান্য-সামান্য অংশ ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাষ্ট্রও হতে পারে এক লক্ষ্মীরাষ্ট্র। প্রতিবছর একটি জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয় দেশে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য থাকে বার্ষিক আয়-ব্যয় বরাদ্দ। আলোচ্য এই বিষয়ের জন্য বলছি, প্রতিবছরের নির্ধারিত বরাদ্দের বাইরে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য কিছু আগাম সঞ্চয় করার কথা। সেটির রূপরেখা সংক্ষেপে বলা যাক। সর্বদা চলমান অগ্রিম ৩০ বছর সময়কাল ধরে নিলাম। ধরি ২০২১ সালটি ১ম বছর। ১ম, ২য়, ৩য় এইভাবে এগোলে ২০২১ সালের ৩০তম বছরটি হবে ২০৫০ সাল। যেহেতু ৩০ বছর সময়কালকে সর্বদা চলমান ধরে নিয়েছি, তাই ২০২২ সালের পরের ৩০তম বছরটি হবে ২০৫১। আবার ২০২৩ সালের পরবর্তী ৩০তম বছরটি হবে ২০৫২ সাল। এখন ধরে নিই, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৩০টি। এই ২০২১ সালে ৩০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত নিয়মিত একটি বার্ষিক বাজেট তো থাকছেই। প্রস্তাব হচ্ছে, এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক নিয়মিত বাজেটের বাইরে, আলাদা একটি খাত খোলা। যে খাতটির নাম হতে পারে ‘আগাম সঞ্চয়ী চলমান বাজেট’। বিষয়টিকে খোলাসা করে বলার জন্য ৩০টি মন্ত্রণালয়ের যে কোন ১টিকে নিলাম। ধরে নিলাম, মন্ত্রণালয়টি কৃষি মন্ত্রণালয়। এই কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের জন্য কমবেশি নিয়মিত একটা বার্ষিক বাজেট তো থাকবেই। ঐ নিয়মিত বাজেটের বাইরে প্রস্তাবিত এই অতিরিক্ত বাজেট খাতে জমানো হবে ১ টাকা। এই ২০২১ সালেই ২০২১ থেকে ২০৫০ পর্যন্ত, পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য প্রতিবছরের বিপরীতে, এ বছরই অর্থাৎ ২০২১ সালেই জমাবো ১টাকা করে মাসে ৩০ টাকা। এই ধারাবাহিকতা প্রতিবার অবিরামভাবে ক্রমাগত পরবর্তী ৩০ বছরকে টার্গেট ধরে চলতেই থাকবে। এখানে উদাহরণ হিসেবে আনা কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাইরে একইভাবে বাদবাকি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য, নিয়মিত বাজেটের বাইরে অতিরিক্ত বাজেটের ঘরে, টাকা জমা হতে থাকবে বর্ণিত ঐ একই প্রক্রিয়ায় অব্যাহতভাবে। তাহলে প্রতিবছর ৩০টি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাবিত এই আগাম অতিরিক্ত বাজেটের হিসাবের ঘরে জমানোর প্রক্রিয়া যদি বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে, তাহলে ঘটনাটি কি ঘটবে, একটু দেখে নেই। ধরেছিলাম, মন্ত্রণালয় ৩০টি। ধরেছিলাম ৩০ বছর। ধরেছি প্রতিবছর ১ টাকা করে জমা করা হবে। তাহলে ৩০ বছরব্যাপী প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর জমা হবে নিম্নরূপ অর্থ-মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৩০ ী বছরের সংখ্যা। ৩০ ী টাকার পরিমাণ ১টাকা = (৩০ ী ৩০ ী ১) = ৯০০ টাকা। ২০২২ সালেও একইভাবে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য জমা হবে ৯০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরই প্রতিটি মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত এই অতিরিক্ত আগাম বাজেট বাবদ পাবে (৯০০ ভাগ ৩০) = ৩০টাকা করে। প্রয়োজনে সম্মিলিত সঞ্চয়ী বাজেট কমবেশি হতেই পারে। তবে তা আগের ন্যায় প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ে (বণ্টনকৃত ৯০০ টাকার ন্যায়) সমবণ্টন হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যমান ঐ ৩০টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি সমান গুরুত্বের এমন নয়। কোনটির আছে বেশি গুরুত্ব, কোনটির বা কিছু কম গুরুত্ব। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব বিচারে প্রতিবছরের হিসাবে ১ টাকার স্থলে কোন কোনটাকে বেশি বরাদ্দ দেয়া যেতেই পারে। যেমন, অধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বলে গণ্য হতে পারে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পর্যটন, পরিবেশ, গবেষণা-উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবেলা মন্ত্রণালয়। কোন বছর বরাদ্দকৃত নিয়মিত বার্ষিক বাজেট এবং প্রস্তাবিত এই অতিরিক্ত বাজেট যদি ঐ মন্ত্রণালয় খরচ করতে না পারে, তাহলে খরচ না হওয়া সেই উদ্বৃত্ত অর্থ ঠিক পরের বছরের অতিরিক্ত বাজেট বলে কেবল গণ্য হবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেকে যাওয়া উদ্বৃত্ত সেই অর্থ সম্পূরক বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করে সংশ্লিষ্ট ঐ মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত এই আগাম সঞ্চয়ী বাজেট খাতে জমা হবে। কিংবা যোগ হবে দূরবর্তী ঐ ৩০তম বছরে। অথবা নিয়ম করা যেতে পারে, বাজেটে প্রাধিকার প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে স্ব স্ব অতিরিক্ত সঞ্চয়ী বাজেটের ঘরে ঐ অখরচকৃত অর্থাৎ অব্যয়িত উদ্বৃত্ত অর্থ সমানভাবে বণ্টন করে দেয়া হবে। আরও শর্ত জুড়ে দেয়া যেতে পারে যে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ঐ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের নিয়মিত বরাদ্দকৃত বার্ষিক অর্থ খরচ করার পরই কেবল, ঐ অতিরিক্ত বাজেটের জমাকৃত অর্থ খরচ করার জন্য হাত দিতে পারবে। এ ছাড়া কোন অজুহাতেই সংশ্লিষ্ট বছরের অতিরিক্ত বাজেট হিসেবে জমাকৃত অর্থের বাইরে খরচ করার এখতিয়ার পাবে না। অর্থাৎ সামনের বছরগুলোর অতিরিক্ত বাজেট খাতে জমা হওয়া তহবিল খরচ করতে পারবে না। নিয়ম করা যেতে পারে, আগাম জমাকৃত ঐ অতিরিক্ত বাজেটের ব্যাপারে, জাতীয় মহাসঙ্কটে ন্যূনতম দুই-তৃতীয়াংশে ভোটে জাতীয় সংসদ নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কেবল। ভবিষ্যতেও সরকার আসবে, সরকার যাবে। দেশের বৃহত্তর কল্যাণ ভাবনায় ‘আগাম সঞ্চয়ী চলমান বাজেট’ খাতটি যদি প্রণীত হয় এবং কল্যাণপ্রসূ বিবেচিত হয় খাতটি, তবে সেটির অব্যাহত অগ্রগামী চলা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যাতে এর চলা মাঝপথে রদ করে না দিতে পারে, সেজন্য একটি সুরক্ষা কাঠামো থাকা দরকার পড়বে। সেই লক্ষ্যে শতকরা ৯০ ভাগ সংসদ সদস্যের অনুমোদন ছাড়া কোন সরকারই এটির চলমানতাকে স্থগিত করতে পারবে না, এমন বিধান করলে ভাল। জাতির ভিতর থেকে আসা যে কোন বিপদে বা দেশের বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া চাপ মোকাবেলা করার যেমন-করোনা আগাম প্রস্তুতি হিসেবে এই অতিরিক্ত সঞ্চয়ী বাজেট বরাদ্দ, সেই সময়কার বিদ্যমান সঙ্কট উত্তরণে দারুণ ভ‚মিকা রাখবে। আগাম সঞ্চয়ী বাজেট বাস্তবায়ন করলে যেকোন মন্ত্রণালয় দেশের অপরিহার্য প্রয়োজনে কোন না কোন মেগা প্রকল্পের উদ্যোগ নিতে পারবে। নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়, এই দীর্ঘমেয়াদী আগাম বাজেট বাস্তবায়ন করলে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের মেরুদণ্ড থাকবে সোজা এবং বলিষ্ঠ। হবে স্বনির্ভর। আগামীতে সেই প্রজন্ম নিজেদের মধ্যে বলাবলি করবে এই বলে, আগের প্রজন্ম নিজেদের জন্য সবটুকু ভোগ না করে আমাদের ভালর জন্য রেখে গেছে অনেক কিছু, করে গেছে অনেক কিছু। বলবে, আমাদের পূর্বপুরুষরা দিয়ে গেছে আমাদের নিরাপদ-বর্তমান। উন্নত জীবনমান। তাদের রেখে যাওয়া সম্পদে ভোগ করছি জীবনের নিরাপত্তা। তাই বলছি, বাংলাদেশসহ যে-কোন দেশের অনাগত ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে, ‘আগাম সঞ্চয়ী চলমান বাজেট’ ধারণাটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এক মাইল ফলক উন্মোচন। লেখক : অধ্যাপক, সরকারী আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
×