ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে বাজেট আলোচনা

প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৫ জুন ২০২১

প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা করোনার এই সঙ্কটকালে রাজস্ব আদায় ও করোনা সংক্রমণ রোধকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জীবন ও জীবিকা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপ সারাবিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু দেশের অতিধনী কিছু আমলাগোষ্ঠী ও দুর্নীতিবাজদের পাঁকচক্রে প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রয়াস অনেকখানিই নিষ্ফল হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা হেফাজতের তাণ্ডব দেখেছি। দেখেছি কিভাবে তারা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল। তারা যে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন পেয়েছিল এটা এখন দলটির মহাসচিবের কথায় স্পষ্ট। আলোচনাকালে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জনবল সঙ্কট নিয়ে অনেক বক্তাই সমালোচনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালসহ বেসরকারী শিক্ষার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনসহ টিকাদান কর্মসূচী এগিয়ে নিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের জন্যও সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নারীরা গার্ড অব অনার দিতে পারবে না সংসদীয় কমিটির এমন প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে তাঁরা বলেন, গার্ড অব অনার আর জানাজা এক নয়। একটি ধর্মীয় বিধি, আরেকটি সরকারী রীতি। তাই এ ধরনের সুপারিশ কেবল দুঃখজনকই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক সপ্তাহের বিরতি শেষে সোমবার জাতীয় সংসদ অধিবেশন শুরু হলে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার সূত্রপাত্র করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান। আলোচনায় অংশ নেন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সরকারী দলের নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, ওয়াশিকা আয়েশা খান, উম্মে কুলসুম স্মৃতি, তাহমিনা বেগম, জাসদের বেগম শিরীন আখতার এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম ও ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সাধারণ আলোচনার সূত্রপাত করে সাবেক মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘অনন্য সাধারণ, সুষম ও সময়োপযোগী বাজেট হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, করোনাকালে গোটা বিশ্বই এখন টালমাটাল অবস্থা। এই সঙ্কটকালে প্রস্তাবিত এই বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব সংগ্রহ ও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা। তবে বিশ্বের সকল বাজেট বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জিং। কোভিডের কারণে সেই চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ কোভিড নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল হয়েছে। তবে কোভিড মোকাবেলায় টিকাদান কর্মসূচীর বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, টিকাদান কর্মসূচী এগিয়ে নিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে টিকা সংগ্রহ, বিদেশী টিকা বাংলাদেশে উৎপাদন এবং দেশেই টিকা উদ্ভাবন ও তৈরি করতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, প্রকল্প পরিচালকদের অবহেলাসহ নানা কারণে উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয় না। প্রকল্প পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হলে প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে ‘মানবতার মা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। করোনার সঙ্কটকালে তাঁর মানবিকতায় ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্যসহ অন্যান্য সাহায্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে বিশ্বের মোড়ল কিছু দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ডবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা পালন করছে। একদিকে বলছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া উচিত, অন্যদিকে মিয়ানমারের অবৈধ সামরিক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তাঁর বক্তব্যে দেশের স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জীবন ও জীবিকা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপ সারাবিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু দেশে অতিধনী সামরিক-বেসামরিক আমলাগোষ্ঠী ও দুর্নীতিবাজদের পাঁকচক্রে প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রয়াস অনেকখানিই নিষ্ফল হয়েছে। তবুও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মানুষের জীবন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক খবরদারিত্বে বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। করোনা রোধে স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক নির্দেশে পরিচালিত হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, চোখের সামনে মাস্ক, পিপিই, করোনা টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি করতে দেখেছি। একজন শাহেদ, একজন সাবরিনা গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু যারা সচিত্র চুক্তি স্বাক্ষর করল, কাজ দিল, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রথমেই টিকা সংগ্রহ করে সফলভাবে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে টিকা সরবরাহের পরিণতি দেখছি। টিকা নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। আগামী মাসগুলোতে টিকা আসবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। দেশের ১২ কোটি মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে না পারলে করোনা সংক্রমণ রোধ হবে না। এই টিকা সরকারকেই সংগ্রহ করতে হবে। দেশে টিকা উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে তাকে কাজে লাগাতে হবে। ১৪ দলীয় জোটের এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা হেফাজতের তাণ্ডব দেখেছি। দেখেছি কিভাবে তারা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল। তারা যে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন পেয়েছিল এটা এখন দলটির মহাসচিবের কথায় স্পষ্ট। কওমি মাদ্রাসাকে শিক্ষার মূল ধারায় নিয়ে আসার বিষয়ে সংসদে বলেছিলাম আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা ‘বিষবৃক্ষ’ লালন করছি কিনা। তার প্রতিক্রিয়ায় হেফাজত মিছিল করে আমার ফাঁসি চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে বাবুনগরী পাকিস্তানী মাদ্রাসার ছাত্র, মুফতি ইজাহার হুজির সদস্য ‘আফগান যুদ্ধ ফেরত তালেবান’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবের নায়ক সাজাদ্দুর রহমান, মোবারক মোল্লা সবাই তালেবান অনুসারী। আমরা বাংলাদেশে আরেকটি তালেবানী অভ্যুত্থান দেখতে চাই কী না সেটা দেখার বিষয়। নারীরা গার্ড অব অনার দিতে পারবে না এমন প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, গার্ড অব অনার আর জানাজা এক নয়। একটি ধর্মীয় বিধি, আরেকটি সরকারী রীতি। তাই এ ধরনের সুপারিশ কেবল দুঃখজনকই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, যারা ক্ষমতায় থাকতে দেশকে ব্যর্থ ও ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল, সেই বিএনপির চোখে ছানি পড়েছে। তারা সরকারের কোন উন্নয়নই দেখতে পায় না। জরুরীভাবে তাদের চোখের অপারেশন করা প্রয়োজন। এরা সবসময় দেশের স্বাধীনতার চেতনাকে ধ্বংস করতে পাকিস্তানীদের দোসর হয়ে কাজ করেছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি তুলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে জনবল বৃদ্ধি জরুরী হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন খাত ও শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহŸান জানান তিনি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও শেখ হাসিনার সরকার একটি প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত, সমৃদ্ধ জাতি গড়তে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছেন। আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে অবশ্যই প্রযুক্তির পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। প্রযুক্তিকে এগিয়ে যাবার হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত একযুগ ধরে জাতিকে সে পথে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল করোনার এই সঙ্কটকালে জনগণ ভোগ করছে। ঘরে বসেই প্রশাসনিক, বিচারিক, শিক্ষা, বিনোদন, মেডিক্যাল সেবাসহ সব ধরনের সেবা পেয়ে যাচ্ছেন। করোনাকালে আড়াই লাখ জামিনের শুনানি হয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। ঘরে বসেই এখন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান হচ্ছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নিরলস প্রচেষ্টার কারণে। জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে ডিজাস্টার ঘটে গেছে। যারা সেকেন্ড ডোজ পাচ্ছেন না তাদের কী হবে? যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভ্যাকসিন নিয়ে সংসদে কোন আলোচনা হয়নি। একক সিদ্ধান্তে কেনার কারণে বাংলাদেশ আজ ট্র্যাপে পড়ে গেছে। উপক‚লীয় অঞ্চলের জীবন-জীবিকা রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানান সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে আছে উপক‚লের জনগণ। তাদের রক্ষায় সরকারের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। জাতীয় পার্টির সালমা ইসলাম বলেন, দেরিতে হলেও সরকার বুঝতে পেরেছে বেসরকারী খাত ছাড়া উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান হবে না। ঋণ খেলাপীদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে, তাদের সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায় করতে হবে। করযোগ্যদের করের আওতায় আনতে প্রয়োজনে ইউনিয়ন পর্যন্ত কর অফিস নিয়ে যেতে হবে। জাসদের শিরীন আখতার বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট আন্দোলন-সংগ্রামের পর বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত এলেও মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্রকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে সচেতনভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। করোনার সময় কোটিপতির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি হতদরিদ্রের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। বৈষম্য মোকাবেলায় নীতিগত কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সরকারী দলের উম্মে কুলসুম বলেন, স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে আমরা অনেক কথা শুনছি। আগামীতে যেন স্বাস্থ্য খাতে দুর্বৃত্তায়ন আসতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অধিক বরাদ্দ দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
×