ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রজন্মের শিক্ষা ও ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ১৫ জুন ২০২১

প্রজন্মের শিক্ষা ও ভবিষ্যত

করোনার দুঃসহ সংক্রমণে বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, নাজেহাল। গত ১৫ মাস ধরে করোনার মারাত্মক ছোবলকে সামলাতে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব দিশেহারা। বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ চিহ্নিত হয় ৮ মার্চ ২০২০ সালে। শুরু থেকে সংক্রমণের হার যেমন নিম্নগামী ছিল পাশাপাশি মৃত্যুর হারও ছিল স্বস্তিদায়ক। বছরটা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বছরের সুবর্ণকাল। সঙ্গত কারণে বহুমুখী উৎসব-আয়োজন আর আনন্দের যোগসাজশে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় বছরটি সাজানো-গোছানো সে সময়ের এক সাড়ম্বর কর্মপ্রকল্প। কিন্তু ওই বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে করোনা যখন তার আক্রমণাত্মক ছোবল উর্ধগতির দিকে নিয়ে যায় সেখানে সরকারকেও ভাবতে হয়েছে ভিন্নমাত্রার সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে, যা আগে কখনও বাংলাদেশসহ বিশ্ব প্রত্যক্ষই করেনি। মহামারীর দাপট পৃথিবীতে এই প্রথম নয়। যুগে যুগে বিভিন্ন কালে সংক্রমণ ব্যাধির উৎপত্তি সময়ের এক অবধারিত পর্যায়। তবে করোনা দেখাল একেবারে নতুন এক জগত। প্রথম পর্যায়ে করোনা মহামারীর প্রকোপে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে আক্রান্ত মানুষ এবং পরিবার হতচকিত, দিশেহারা সে সময় শুধু রোগীকেই আলাদা করার বিষয়টি ছিল মূল ব্যাধিটিকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার কৌশল। ২০২০ সাল পর্যন্ত সেটাই ছিল প্রচলিত বিধি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়। কিন্তু করোনার ছোঁয়াচে সংক্রমণে এতদিনের সব ধারণা পাল্টে গেল। শুধু যে রোগীকে আলাদা করলে অন্যরা সুরক্ষিত থাকবে এবারের মহামারী তেমন ধারণার ওপর আস্থা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শুরু হলো সুরক্ষার স্বাস্থ্যবিধির আধুনিক, নতুন নিয়মকানুন। অসুস্থ ব্যক্তিকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেও সুস্থ মানুষকে সুরক্ষা দেয়া অসম্ভবের পর্যায়ে ঠেকল। সঙ্গত কারণে সুস্থ মানুষকেও বিধিসম্মত উপায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অভ্যস্ত হতে করোনাই শিক্ষা দিল। ফলে নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখতে পৃথিবীর তাবত মানুষ মুখে মাস্ক, হাতে স্যানিটাইজার ব্যবহার বাড়িয়ে দিল এবং আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার বিষয়টি যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেল। আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ অন্য দেশের তুলনায় কম দৃশ্যমান হলেও ভয়ঙ্কর এই রোগটির প্রকোপে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত, উদ্বিগ্ন। জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর রুদ্ধতার জাল বিস্তার করে শিক্ষার্থীদের সুবর্ণ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় দেশের অগণিত উদীয়মান প্রজন্মের জীবনে যে দুঃসহ ক্রান্তিকাল নেমে আসল তা থেকে মুক্তির উপায় নির্দেশিত না হওয়াও দেশের জন্য এক অশনি সঙ্কেত। যদিও ইতোমধ্যে অনলাইনভিত্তিক ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের দৃশ্য কতখানি গ্রহণযোগ্য কিংবা সর্বজনীন হয়েছে সে প্রশ্নও সংশ্লিষ্ট মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পাঠদান এবং গ্রহণ আসলে ফলপ্রসূ হয়েছে কিনা তেমন জরিপও উঠে আসতে সময় লাগেনি। বিশেষ করে প্রাইমারী পর্যায়ের খুদে শিক্ষার্থী, যারা তথ্যপ্রযুক্তির এই বলয়টিতে কোনভাবেই যুক্ত ছিল না। শিশুরা হয়তবা কম্পিউটারে গেম খেলেছে নতুবা তাদের উপযোগী কার্টুন ছবি দেখে সময় কাটিয়েছে, যা পারিবারিক আঙ্গিনায় বাবা-মায়েরাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু প্রতিদিনের শিক্ষা কার্যক্রম যখন আধুনিক বৈজ্ঞানিক বলয়ে তখন এই জগতে সন্তানকে যুক্ত করে দেয়া ছাড়া অভিভাবকদের বিকল্প কোন পথও ছিল না। তার ওপর শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মবিধিতে শিক্ষালয়ে গমনের ওপরও পড়ে এক অনাবশ্যক উপায়হীনতা। শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে সরকারী সিদ্ধান্তে সংসদ টিভিতে পাঠদান কর্মসূচী শুরু করা গেলেও প্রশিক্ষণ এবং যথেষ্ট মনোযোগের ঘাটতিতে নতুন পাঠক্রম প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই হিমশিম খেতে হয়। সময়ও গড়িয়ে গেছে অকারণে, অপ্রয়োজনে বলা যেতেই পারে। গ্রামনির্ভর কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীই বাস করে গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যাদের অনেকের ঘরে টিভি পর্যন্ত নেই। আবার যাদের টিভি আছে তথ্যপ্রযুক্তির বিভ্রাটে সংসদ টিভি তাতে দৃশ্যমানও হয়নি। যারা শহরে-বন্দরে সংসদ টিভি দেখার সুযোগ পেয়েছে তারাও যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেনি বলে ব্র্যাকের এক জরিপে উঠে আসে। শিশুদের আসক্তি বেড়েছে তথ্যপ্রযুক্তির আঙ্গিনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মানসিক বিকাশে বিঘœও ঘটেছে, যা সংশ্লিষ্টদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু না হয়ে ভিন্নমাত্রার উপসর্গ তৈরির মাধ্যম হয়েছে। যাকে অনভিপ্রেত এবং অনাকাক্সিক্ষত বললেও বেশি বলা হয় না। আর মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ভার্চুয়াল জগতও কোনভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেখানেও অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে অভ্যাস এবং মনোযোগ নিবদ্ধ করা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কারও জন্যই সহজ এবং স্বাভাবিক ছিল না। সেটাও আয়ত্তে আনতে বেশ সময় পার হওয়ার দৃশ্যও সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। অর্থাৎ উদীয়মান তরুণ এবং যুবকদের ক্ষেত্রে এমন শিক্ষাদান কর্মসূচী সর্বাঙ্গীণ সফল হতেও বিষন্ন তৈরি হয়েছে। ১৫ মাস বন্ধ থাকার পরও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কোন সুযোগ এখনও তৈরি না হওয়ার দুঃসহ চিত্র সংশ্লিষ্টদের অস্থির করে তুলছে। শিক্ষার্থীরাও ভাল নেই। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাও অসহনীয় সময় পার করছেন । তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকার আওতায় আনাও সময়ের দাবি। তবে এই মুহ‚র্তে দেশে চলছে টিকার সঙ্কট। পর্যাপ্ত টিকা বাইরে থেকে আনা কিংবা দেশে উৎপাদন করা সম্ভব না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। সঙ্গত কারণে প্রায় ১৫ মাসের ক্ষতি আরও কত মাস গড়াবে তাও এক অনিশ্চিত আশঙ্কা। সবচেয়ে অস্বস্তিকর চিত্র যা ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অনেক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া। সেটা প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিষয়টিও সরকারকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। শিক্ষা কার্যক্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচক আজও যে মাত্রায় দুঃসহ সময় পাড়ি দিচ্ছে তাতে অগণিত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাও এক উদ্বেগের বিষয়। চার কোটি শিক্ষার্থী এখনও তার মূল্যবান সময় অপচয় করে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে তার শেষ গন্তব্য কত দূরে? যত দ্রæত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে ইতোমধ্যে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। তবে সরকার কয়েকবার শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে তা করা সম্ভব হয়নি। করোনা সংক্রমণের অসহনীয় দাপটে আবারও যে দুরবস্থা দৃশ্যমান হচ্ছে সেটাই পাড়ি দেয়া এইা মুহূর্তে সব থেকে জরুরী। সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, সাতক্ষীরা ও যশোরে যে ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্টের অনুপ্রবেশ তাতে করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার চিন্তা না করে বরং আসন্ন বহুল সংক্রমণকে সঠিক পদক্ষেপে ঠেকানোই জরুরী হয়ে পড়েছে। এদিকে শিক্ষা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে অবরুদ্ধ রাখতেই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। তবে কঠোর লকডাউনের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সব কার্যক্রম উন্মুক্ত এবং অবারিত, যা জাতির মেরুদণ্ডে চরম আঘাত হানতে খুব বেশি সময় নেবে না। কারণ ইতোমধ্যে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের যে ক্ষতি দৃশ্যমান তা পোষাতে আরও কত সময় লাগবে তা ধারণার বাইরে। তার ওপর মেধা ও মনন যাচাইয়ের সব ধরনের পরীক্ষা কার্যক্রমও স্থবির। ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিতই হতে পারেনি। মাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিকের মান যাচাই করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশের পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গৃহীত হয়েছে। যদিও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষাজীবনে শিক্ষার্থীদের নিজেকে তৈরি করে পরবর্তীতে দেশ গড়ার কারিগরের ভ‚মিকায় নামতে হয়। এখানে সময় নষ্ট করার বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকে না। আজকের শিক্ষার্থী আগামীর অগ্রযাত্রার যথার্থ সেনানী। তাই তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে প্রাসঙ্গিক বিধিগুলো আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় সবই করা সময়ের দাবি। ঠাণ্ডা মাথায়, যৌক্তিক সিদ্ধান্তে করোনার বহুল সংক্রমণকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক দ্বার উন্মোচন করা দেশ ও জাতির স্বার্থে জরুরী। এমন বিপন্ন দুরবস্থা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনাও আবশ্যক। লেখক : সাংবাদিক
×