ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার উৎখাতের নীলনক্সা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাবুনগরী ও মামুনুলকে মামুনুলের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করতেন তারেক জিয়া

ব্যাঙ্ককে হেফাজত বিএনপি গোপন বৈঠকে ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ২২ এপ্রিল ২০২১

ব্যাঙ্ককে হেফাজত বিএনপি গোপন বৈঠকে ষড়যন্ত্র

শংকর কুমার দে ॥ হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে ব্যাঙ্ককে বিএনপি নেতাদের গোপন বৈঠকে নাশকতার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ব্যাঙ্কক ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছে লন্ডন থেকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহিংস সন্ত্রাসের তা-ব চালানোর জন্য চালকের আসনে বসানোর সিদ্ধান্ত হয় হেফাজতে ইসলামকে। হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের সঙ্গে লন্ডনে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপার্সন তারেক জিয়ার গোপন যোগাযোগ থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। যে কোন সময়ে গ্রেফতারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীকে। হেফাজতের তা-বের অভিযোগে অব্যাহত গ্রেফতার অভিযানের মুখে হফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের প্রচার সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। দেশব্যাপী তা-বের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে হেফাজত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করছেন আলেম ওলামা মাশায়েখগণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় এসে শেষ রক্ষা করার জন্য নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেছেন হেফাজত নেতৃবৃন্দ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের কয়েক মাস আগে গত বছর একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্যাঙ্ককে। ব্যাঙ্ককের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা ও বিএনপির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হেফাজতের প্রয়াত মহাসচিব ও কাসেমী পদবির হেফাজত নেতা। আর বিএনপির পক্ষে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বিএনপিতে যাওয়া একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতার নেতৃত্বে বিএনপির নেতৃবৃন্দ। ব্যাঙ্ককে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সরকার উৎখাতের একটি নীলনক্সা তৈরি করা হয়। সেই নীলনক্সা অনুযায়ী হেফাজত পরবর্তীতে পুনর্বিন্যস্ত করে করণীয় নির্ধারণ করা হয়। সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের কঠোর অবস্থান গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বৈঠকে। ব্যাঙ্কক বৈঠকে দেশের ভেতরে নাশকতা ও সহিংস তা-ব চালানোর ছক কষা হয়। বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য ব্যাঙ্কক উড়ে যান বিএনপির অন্তত পাঁচ জন নেতা। কয়েকজন হেফাজত নেতারও তখন ব্যাঙ্ককে উড়ে যাওয়ার খবর পায় গোয়েন্দা সংস্থা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কাসেমী পদবির একজন হেফাজত নেতা। কাসেমী পদবির হেফাজতে ইসলামের নেতার সঙ্গে ছিলেন গ্রেফতার হওয়া হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকও। বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদার বিএনপির একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা বৈঠকের যাবতীয় খরচ বহন করেন। বিএনপির এই শীর্ষ নেতার ব্যবসা বাণিজ্যও ব্যাঙ্কক ঘিরেই। ব্যাঙ্কককে ঘিরেই এই শীর্ষ বিএনপি নেতা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলেও জানা যায়। ব্যাঙ্কক ষড়যন্ত্রমূলক ওই বৈঠকের উদ্যোক্তা ছিল বিএনপি। মূলত বিএনপি অসংগঠিত এবং আন্দোলন করতে অক্ষম। এই বাস্তবতায় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজতকে সামনে নিয়ে এসে সারাদেশে সহিংস তা-ব তৈরি করে পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল ওই বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাঙ্ককের ওই বৈঠকের প্রেক্ষিতে হেফাজতের নেতারা ঢাকায় ফিরে এসে হেফাজতে ইসলামকে নাশকতা ও সহিংস তা-বের পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতার আড়ালে দেশে অস্থিতিশীলতার ছক কষা হয়। ব্যাঙ্ককের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বাবুনগরী তার পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে, যারা স্বাধীনতার রিবোধী, বিএনপিপন্থী তাদের বেছে বেছে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়। হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটিকে সরকার বিরোধী সংগঠন হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বাবুনগরী ও মামুনুল হকের নেতৃত্বে আমির আল্লামা শফীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়, যা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধর্মের অপব্যাখা করে উন্মাদনা সৃষ্টি করে পুলিশের সামনে দাঁড় করিয়ে শাহাদাৎ বরণ করতে উৎসাহিত করার নীলনক্সা করা হয়। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করে বলা হয়, শাহাদাৎ বরণ করা হলে জান্নাত নিশ্চিত। এভবেই সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পরিকল্পনা আঁটা হয়। সরকারকে একটা কোণঠাসা অবস্থায় ফেলে সরকার উৎখাত করার একটা নীলনক্সা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে দেয়া হয় বাবুনগরী ও মামুনুল হককে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছরের পদার্পণে এসে স্বাধীনতার দিন ২৬ মার্চকে বেছে নিয়ে দেশব্যাপী নাশকতা ও সহিংস তা-বের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো হয়। সরকারের সঙ্গে আগে আলাপ আলোচনা করা হয় যে, হেফাজতে ইসলাম কোন কর্মসূচী দিবে না-এই ধরনের কথাবার্তা বলে সরকারকে ঘুমে রেখে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে দেশে নাশকতা ও সহিংস তা-ব চালানোর ছক কষা হয়েছিল ব্যাঙ্কক ষড়যন্ত্রে। এই ব্যাঙ্কক ষড়যন্ত্রের তদন্তকে সামনে এনেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হককে গ্রেফতার করে এখন পুলিশী রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। জিজ্ঞাসাবাদে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক তথাকথিত বিবাহের নামে একাধিক নারীকে যৌনদাসী হিসাবে ভোগ করাসহ তার ব্যক্তিগত জীবন সস্পর্কে যেমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে মানুষজনকে উত্তেজিত করার পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকার বিষয়ে চমকে যাবার মতো তথ্য দিচ্ছেন তিনি। লন্ডনে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক জিয়ার সঙ্গে মামুনুল হকের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তারেক জিয়ার সঙ্গে মামুনুল হকের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে তারেক জিয়ার সঙ্গে কানেকশনের কারণেই মামুনুল হক বিভিন্ন সময় উগ্রবাদী কথাবার্তা বলে উস্কে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করতেন এমনটা নিশ্চিত হতে চেষ্টা করছে পুলিশ। তারেক জিয়া লন্ডন থেকে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হেফাজত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। হেফাজত নেতৃবৃন্দের যাদের সঙ্গে তারেক জিয়া যোগাযোগ রক্ষা করতেন তাদের মধ্যে মামুনুল হক অন্যতম। আর এ কারণেই মামুনুল হক ধর্মের অপব্যাখা করে সরকার বিরোধী উস্কানিমূলক কথা বলা শুরু করেন। মামুনুল হকের কারণেই হেফাজত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে কঠোর অবস্থানে গিয়েছিল এবং সারাদেশে তা-ব চালানোর মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মামুনুল হক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতার নামে হেফাজতের তা-বের ঘটনায় উস্কানি দিয়েছে তারেক জিয়া-এই বিষয়গুলো এখন তদন্তের সামনে এনে মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হেফাজত নেতা আতাউল্লাহ আমিন গ্রেফতার ॥ হেফাজতে ইসলামের সহিংস সন্ত্রাসের তা-বের বিরুদ্ধে অব্যাহত গ্রেফতার অভিযানের মুখে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের প্রচার সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বুধবার ভোরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে র‌্যাব সদরদফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা ও ২০১৩ সালের মামলা রয়েছে তার নামে। এছাড়া তিনি উস্কানিমূলক বক্তব্যও দিয়েছেন। আতাউল্লাহ আমিনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় বাবুনগরী ॥ হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীকে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ অসংখ্য সহিংস সন্ত্রাসের তা-বের মামলায় আসামি তিনি। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে ৯ টি মামলায় তাকে গ্রেফতারের জন্য প্রস্তুতি চলছে। ২০১৩ সালের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা রয়েছে। এসব মামলার একটিতে তাকে ২০১৩ সালে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই মামলাগুলো আবার সচল করা হয়েছে। এসব মামলার জন্য কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জুনায়েদ বাবুনগরীর নামই বলেছেন। এই কারণে ধারণা করা হচ্ছে যে, ওইসব মামলায় শেষ পর্যন্ত হয়তো জুনায়েদ বাবুনগরীকে যে কোন সময়ে গ্রেফতার করা হতে পারে। জুনায়েদ বাবুনগরী গ্রেফতার হলে যেন কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে কারণেই তার চারপাশে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যেভাবে ঢাকায় মামুনুল হকের গ্রেফতার করা হয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় বাবুনগরীকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে হেফাজত ॥ হেফাজতের নেতাদের অব্যাহত গ্রেফতারের মুখে বেসামাল হয়ে পড়েছে ধর্মান্ধ ও উগ্র মৌলবাদী হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি। হেফাজতের প্রায় এক ডজন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর রাতের বেলায় হেফাজতের কয়েকজন নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কওমি মাদ্রাসা খুলে দেয়া এবং ধরপাকড় বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেলিন তারা। কিন্তু ধরপাকড়ের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে ঢালাওভাবে ধরপাকড় হচ্ছে না বরং সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই এই ধরপাকড় করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আর কওমি মাদ্রাসা খুলে দেয়ার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন বিষয় বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের জানিয়ে দেন। হেফাজতের নেতারা বুঝে গেছেন যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন তাদের রক্ষা করতে পারবেন না। আর এ কারণেই হেফাজত গতরাতে তাদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে একটি নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া সংক্রান্ত চিঠি দেবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তবে এই চিঠি প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমকে দেয়া হবে না কি গোপনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হেফাজতের চট্টগ্রামের দুই নেতাকে এই চিঠির খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২৬ এবং ২৭ মার্চের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং এখানে হেফাজতের যদি কোন ভূমিকা থাকে সেই ভূমিকার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে। এই চিঠিতে কওমি মাদ্রাসা খুলে দেয়া এবং আলেম-ওলামাদের গ্রেফতার না করাসহ বেশকিছু অনুরোধ জানানো হবে প্রধানমন্ত্রীকে। তবে কবে এই চিঠিটি পাঠানো হবে সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভেঙ্গে যাচ্ছে হেফাজত ॥ এই সময়ে হেফাজতে ইসলাম দেশের সবচেয়ে আলোচিত নাম, আলোচিত ধর্মান্ধ ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠন। শুরুতে সংগঠনটি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হলেও সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্ব সংগঠনটিকে এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা কখনও নিজেদের সুবিধার্থে হেফাজতকে ব্যবহার করেছে, কখনও সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আবার কখনও ব্যবহার হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রে। এভাবে নানা জায়গায় ব্যবহার হতে হতে হেফাজতে ইসলাম এখন ব্যবহারের অযোগ্য একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আর এই অবস্থার জন্য দায়ি করা হচ্ছে সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্বকে। বিশেষ করে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হকদের। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হেফাজতকে ব্যবহার করেছে। আর এ কারণে এসব শীর্ষ নেতাদের অপকর্মের দাগ যাতে হেফাজতের গায়ে না থাকে সেজন্য নতুন করে হেফাজতে ইসলামকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী হেফাজতের একটি সূত্র বলছে, শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পরেও হেফাজত নেতারা আশায় ছিলেন যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে যদি সরকারের অবস্থান শিথিল করা যায় তাহলে হয়তো এই নেতৃত্বে দিয়েই হেফাজতকে চালানো যাবে। কিন্তু সরকার এবার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখারা জন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যারা অপরাধ করেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে এবং সহিংসতা বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল সেসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই এই ধরপাকড় করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে হেফাজত নেতৃবৃন্দকে। সরকারের এই অবস্থানের কারণে হেফাজত নেতারা ঘাবড়ে গেছেন। একদিকে সরকারের কঠোর অবস্থান, অন্যদিকে শীর্ষ নেতাদের অপকর্ম একে একে প্রকাশ্যে আসায় দলীয় কর্মীদের মধ্যে বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ চরমে। ফলে হেফাজতে নেতারা মনে করছেন নতুন মুখকে নেতৃত্বে এনে এই কমিটি ভেঙ্গে দিলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা ঠা-া হবে এবং পরবর্তীদের সিদ্ধান্ত নিয়ে দলীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। যেহেতু বর্তমান কমিটির অধিকাংশ পরিচিত নেতারা কোন না কোনভাবে সরকার বিরোধিতা এবং বিভিন্ন আর্থিক অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন তাই নতুন মুখের কেউ যদি নেতৃত্বে আসে তাহলে সরকার হয়তো নমনীয় হতে পারে হেফাজতের ব্যাপারে এবং সমালোচনা থেকেও রক্ষা পাবে হেফাজত। আর হেফাজতে ইসলামকে ঢেলে সাজানোর জন্য নতুন মুখ হিসেবে প্রয়াত আমীর আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর পূত্র আনাস মাদানীর নাম শোনা যাচ্ছে হেফাজতের অন্দরমহলে। হেফাজতে ইসলামের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতের কমিটি ভেঙ্গেই শেষ নয় পরিবর্তন আসছে হেফাজতের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের ওপরে। বিশেষ করে এতদিন হেফাজতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল কওমি মাদ্রাসাগুলোতে। কিন্তু এখন নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী কওমি মাদ্রাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত নেবে নির্ধারিত বোর্ড ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’। মাদ্রাসা পরিচালনায় কোনধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না হেফাজতে ইসলাম। এতে করে হেফাজতের আধিপত্য বহুগুণে কমে যাবে। এ ছাড়া এ অবস্থায় সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে উল্টো সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে চাচ্ছে দলটি। তবে দেশজুড়ে সহিংসতায় জড়িতদের কোন ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল তাদের সহিংস তা-বের মুখে নতি স্বীকার করবে সরকার। কিন্তু হেফাজতের ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেছে। সরকার সহিংস তা-ব কঠোর হস্তে দমন করছে। হেফাজতের সর্বশেষ ধারণা ছিল তারা চাইলেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারবে এবং সরকার তাদের প্রস্তাবে রাজি হবে। কিন্তু সরকার এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং সরকারের কৌশলের কাছে ইতিমধ্যে হেফাজতের পরাজয় হয়েছে। ফলে হেফাজত এখন যতই নরম হোক সরকারের হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বিকল্প ভাবছে হেফাজত নেতারা। তবে শেষ পর্যন্ত হেফাজত কমিটি ভেঙ্গে নতুন নেতৃত্ব এনে সংগঠনকে শেষ রক্ষা করতে পারবে কি না তা নিয়ে সব মহলেই বলাবালি হচ্ছে। হেফাজতের ওপর ক্ষোভ বাড়ছে ॥ বাংলাদেশ সোস্যাল এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বিএসএএফ) প্রধান সমন্বয়ক মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী ও সমন্বয়ক শেখ জনি ইসলাম গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, কওমি মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে মাঠে নামিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতার আন্দোলনের নামে সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের প্রকাশ্যে হেফাজতে ইসলাম হলেও নেপথ্য নায়ক অন্য কেউ। আর সেই সময়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর লক্ষ্য করলেই তা স্পষ্ট হবে, বিএনপি-জমায়াতই তাদের আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর ও পৃষ্ঠপোষক। এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তাই এই নেপথ্য নায়ক, কুশীলব, হেফাজতের হরতালে সমর্থনদাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি করছি। তারা বলেন, হেফাজতে বর্তমান কমিটির অধিকাংশ নেতৃত্বই হলো বিএনপি-জমাত জোটের শরিক খেলাফত মজলিশ (ড. আহমেদ আবদুল কাদের), ইসলামী ঐক্যজোট (এ্যাডভোকেট আবদুর রকিব) অংশের নেতারাই। এরা কমিটির প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্য ইসলামিক দলের নেতাদের আধিপত্য একেবারেই কম। সুতরাং এর পেছন থেকে বিএনপি-জমায়াতের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। তারা আরও বলেন, হেফাজতের হরতালে ২০ দল প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও জমায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট এহসানুল হুদা প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন এবং দলের নেতা-কর্মীদের নিয়েও মাঠে থাকার ঘোষণা দেন। তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল, ৭১’র পরাজিত শক্তি ও জমায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠা ষড়যন্ত্রকারী হেফাজত নেতাদের পাশাপাশি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল (অব.) ইবরাহিম, জাতীয় দলের সভাপতি এ্যাডভোকেট এহসানুল হুদা, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরসহ সবাইকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাই দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশের লক্ষ্যে এদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি করছি।
×