ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে টিকার কার্যকারিতা

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২১ এপ্রিল ২০২১

সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে টিকার কার্যকারিতা

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হু হু করে বাড়ছে। বিগত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ সংক্রমণ যখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, অনেকেই হয়ত ভেবে বসেছিলেন দেশে করোনা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। সাধারণ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় এক রকম গাছাড়া ভাব দেখা দেয়। চারদিকে বিয়ে-শাদি, সভা-সমাবেশ, ঘোরাঘুরি এসবের ধুম পড়ে যায়। কিন্তু মাঝ ফেব্রুয়ারি থেকে সংক্রমণ ফের বাড়তে শুরু করে, মার্চের মাঝামাঝি তা ক্ষিপ্রগতিতে উর্ধমুখী হয়। এপ্রিলের প্রথম অংশে এসে নতুন শনাক্তের সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে টানা কয়েকদিন ৭ হাজারের ওপরে অবস্থান করে। গত কয়েকদিন নতুন শনাক্তের সংখ্যায় আপাতদৃষ্টিতে একটি নিম্নমুখী প্রবণতা দৃশ্যমান হলেও পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এতে মনে হতে পারে নতুন শনাক্তের সংখ্যার এ নিম্নগতি হয়তবা অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক পরীক্ষা সম্পাদনের ফল। বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার নতুন ঢেউ আঘাত হেনেছে। স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশেও এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে ধারণা করা হচ্ছিল এটা শীতে আসবে। কিন্তু বাস্তবে এলো গরমে। নতুন এ ধাক্কার পেছনে হেতু কি? নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যবিধি মানায় সাধারণ্যের গাফিলতি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষিপ্রগতি এখানে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অবশেষে সাম্প্রতিক সময়ে সিএইচআরএফ ও আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত দুটি গবেষণা থেকে বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক করোনা রোগীদের ৮০-৮১ শতাংশ করোনাভাইরাসের সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং ১০-১২ শতাংশ ইউকে ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছেন। দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের ইউকে ও সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় যথাক্রমে ৬ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এরপর দ্রুত এর জায়গা দখল করে নেয় সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, যার শতকরা হার মার্চের শেষ নাগাদ ৮১ শতাংশে পৌঁছে। যদিও এ গবেষণাসমূহ স্বল্পসংখ্যক নমুনার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তথাপি এগুলো থেকে দেশে এসব ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতির একটি মোটামুটি চিত্র অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে। একটি ভাইরাস যখন বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার প্রতিলিপি তৈরি করে তখন মাঝে মাঝে এর জেনেটিক মেটেরিয়ালে ছোটখাট ত্রুটি ঘটে। একেই আমরা মিউটেশন বলি এবং এভাবেই নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঘটে। ভাইরাস জগতে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১৯ সালের শেষ পাদে আবির্ভাবের পর থেকে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ৪ হাজারের অধিক ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। এ ধরনের একটি ভ্যারিয়েন্ট কেবল তখনই বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন তা দ্রুততর গতিতে ছড়ায়, রোগের লক্ষণাদিতে পরিবর্তন আনে কিংবা অধিকতর শারীরিক সমস্যা কিংবা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, শনাক্তকরণের নিয়মিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে যায়, প্রচলিত ওষুধ কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় অথবা ক্ষেত্রবিশেষে ইতোপূর্বেকার সংক্রমণ কিংবা টিকা গ্রহণের ফলে একজন ব্যক্তির শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তার প্রতি সাড়া না দেয়। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্টসমূহকে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন নামে অভিহিত করা হয়। বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এ ধরনের চারটি ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করেছেন, যথা- ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭), সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি.১) এবং ক্যালিফোর্নিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৪২৭ এবং বি.১.৪২৯)। দেশে গত মার্চে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে। তবে সম্ভবত এখনও ক্যালিফোর্নিয়ান ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির কোন তথ্য মেলেনি। ইউকে, সাউথ আফ্রিকান ও ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এদের সকলের স্পাইক প্রোটিনে N501Y নামে একটি কমন মিউটেশন ঘটেছে, যা তাদের মানবকোষের ACE2 রিসেপ্টরের সঙ্গে আরও ভালভাবে আবদ্ধ হতে সাহায্য করে। এটিই এদের করোনাভাইরাসের মূল সংস্করণের (wild type)-চেয়ে অধিকতর সংক্রামক হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক মূল করোনাভাইরাসের তুলনায় ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ৩০-৫০%, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ৫০% এবং ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ১৫০% অধিকতর সংক্রামক। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে ঊ৪৮৪ক এবং ক৪১৭ঘ নামে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন দেখা যায়। এই মিউটেশনসমূহের কারণে করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে মূল ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এ্যান্টিবডি ঠিকমতো যুক্ত হতে পারে না। এটার মানে দাঁড়াচ্ছে ইতোপূর্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তি এই ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া মূল করোনাভাইরাসকে টার্গেট করে ইতোমধ্যে যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নাও দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডাঃ এন্থনি ফ’সির ভাষায় ‘সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে উদ্বেগের। কারণ এতে যে মিউটেশন ঘটেছে তা একে টিকা গ্রহণ বা ইতোপূর্বে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরে যে এ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা থেকে ‘লুকিয়ে’ থাকতে সাহায্য করে। ফলে এর বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে।’ (Covid mutations could prolong the pandemic another year, health officials warn | Daily Mail, Jan 29, 2021 উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টেও অনুরূপ মিউটেশনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে (E484K, K417T)। এবার আসুন রোগীর ভোগান্তি ও মৃত্যুর নিরিখে এসব মিউটেশনের অবস্থান বিবেচনা করা যাক। যুক্তরাজ্য সরকারের নিউ এ্যান্ড ইমার্জিং রেসপিরেটরি ভাইরাস থ্রেটস এ্যাডভাইজরি গ্রুপের (নার্ভট্যাগ) মতে ইউকে ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০-৪০% বেশি। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট অধিকতর প্রাণঘাতী বলে প্রতীয়মান না হলেও সাউথ আফ্রিকায় দেখা গেছে সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে হাসপাতালসমূহ চাপে পড়ে যাওয়াতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এদেশেও দিনের পর দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে দেশে ডাক্তাররা দেখছেন সাম্প্রতিক সংক্রমণসমূহে অনেক রোগীর দ্রুত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে (৩০-৪০%) ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৪০-৫০ শতাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। রোগের উপসর্গেও এসেছে পরিবর্তন। সর্দি-কাশি কিংবা জ্বরের মতো প্রথাগত উপসর্গের পরিবর্তে অনেকেই মাথাব্যথা, ডায়রিয়া ও অস্বাভাবিক আচরণসহ নানা উপসর্গ নিয়ে আসছেন এবং টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। এবারকার সংক্রমণে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এখানে তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। (করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফা সংক্রমণে তরুণদের আক্রান্তের হার বেশি । চ্যানেল আই, মার্চ ১৬, ২০২১) এ মুহূর্তে সম্ভবত প্রধান একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে- এসব ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে বিদ্যমান টিকাসমূহ কতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে এ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় অকার্যকর। অন্য একটি গবেষণা মতে এক্ষেত্রে নোভাভ্যাক্সের কার্যকারিতা প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে তীব্র সংক্রমণের বিরুদ্ধেও এ্যাস্ট্রাজেনেকা বা নোভাভ্যাক্স কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে তা স্পষ্ট নয়। জনসন এ্যান্ড জনসনের ভ্যাক্সিন নিয়ে পরিচালিত একটি বড় পরিসরের গবেষণায় এটি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের তীব্র সংক্রমণ রোধে ৮৫% কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফাইজারের ভ্যাক্সিন নিয়ে পরিচালিত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট গবেষণায় এটি এমনকি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতেও শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। (Vaccines And Variants: What We Know So Far : Goats and Soda : NPR, April 09, 2021) দেশে ইতোমধ্যে টিকাদান কর্মসূচী চালু হয়েছে। আমরা এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিচ্ছি। যেহেতু এ মুহূর্তে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা প্রশ্নসাপেক্ষ, সেহেতু আমাদের এ ব্যাপারে আরও খোঁজ-খবর নেয়া এবং বিকল্প টিকা সংগ্রহের বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে করোনা উপদ্রুত এলাকাসমূহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বড় পরিসরে সমীক্ষা চালিয়ে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের অঞ্চলভিত্তিক বিস্তৃতি নির্ধারণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। অন্যথায় টিকাদান কর্মসূচী কাক্সিক্ষত ফলদানে ব্যর্থ হতে পারে। লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×